কৃষক খায়রুল ইসলামের সাশ্রয়ী পানি ব্যবহারের কৌশল
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
ভূমিকা
ভূত্বকের নিচের পানির স্তরকে ভূ-গর্ভস্থ পানি বলে। নিরাপদ পানির উৎস হচ্ছে এই ভূ-গর্ভস্থ পানি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে, খাল, বিল, হাওড় ও নদী নালাতে পানি থাকে না বলে কৃষক সেচ কাজে ভূ-গর্ভের পানি ব্যবহার করেন। কিন্তু ভূ-গর্ভের পানির অতিরিক্ত উত্তোলনের কারণে এই পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মানুষ জন্মগতভাবেই অর্জন করেছে নতুন কিছু সৃষ্টি করার অদম্য ক্ষমতা। এ ক্ষমতাকে সমৃদ্ধ করেছে তাদের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের কৃষক মো. খায়রুল ইসলাম ভূ-গর্ভস্থ পানির সীমিত উত্তোলনের মাধ্যমে পানির অপচয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাবকে রোধ করার চেষ্টা করছেন।
কি ধরণের উদ্যোগ/চর্চা
কৃষক খায়রুল ইসলাম তার চাষকৃত জমিতে বাঁশের চোঙ্গার সাহায্যে পানি সেচ দিয়ে থাকেন। খায়রুল ইসলামের বাড়ি কান্দাপাড়া গ্রামে অবস্থিত হলেও তিনি কাজ করেন একই ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে। উক্ত গ্রামের একজন বড় কৃষকের দুইটি সেচ মেশিন আছে। খায়রুল ইসলাম এগুলোর পরিচালনার কাজ করেন বিগত ছয় বছর যাবৎ।
পদ্ধতি
খায়রুল ইসলাম বছর তিনেক আগেও অন্যদের মতই সাধারণ পদ্ধতিতে বোরো মৌসুমে জমিতে পানি সেচ দিতেন। তখন জমি পরিচর্যা করার সময় তিনি দেখতেন কোন জমি পানিতে ভরে গেছে আবার কোন জমিতে পানি নেই। দিনের বেলায় বেশ কয়েকবার জমির আইল খুলে বা বেঁধে দিতে হতো। এমনকি তিনি রাতেও ঘুম থেকে উঠে এই কাজই করতেন। আবার পানির অপচয়ও হতো। কারণ ভরা জমির পানি উপচিয়ে পড়তো। তাই তিনি নিজের বুদ্ধি আর কৌশল অবলম্বন করে বাঁশের চোঙ্গার সাহায্যে জমিতে পানি দেওয়া শুরু করলেন। জমির পরিমাণ অনুযায়ী তিনি চোঙ্গার আকার নির্ধারণ করেন। জমির পরিমাণ বেশি হলে চোঙ্গার আকার বড়, আবার জমির পরিমাণ কম হলে চোঙ্গা হয় ছোট। তিনি প্রতিটি জমির আইলে একটি করে চোঙ্গা লাগিয়ে রেখেছেন, যার একদিক জমির ভেতরের দিকে অন্যদিক পানির মূল নালা বা ড্রেনের সাথে যুক্ত। সব জমিতে একই সাথে পানি দেওয়া হয় না। তাই যখন কোন জমিতে পানি দেয় তখন নালার অপর পাশে থাকা চোঙ্গার মুখটি খুলে দেন। আর যে সব জমিতে পানির প্রয়োজন নেই সেই জমিগুলোর চোঙ্গার মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ রাখেন। এই পদ্ধতিতে তিনি বর্তমানে প্রায় ৩’শ কাঠা জমিতে পানি সেচ দেন।
এই পদ্ধতির উপকারিতা
এই পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনি অনেক দিকে লাভবান হয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার পরিশ্রম ও সময় কম লাগে। চোঙ্গা থাকার কারণে জমিতে পরিমাণ মতো পানি যায়। আবার পানির পরিমাণ দেখার জন্য আমার বারবার জমিতে যাইতে হয় না। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিদ্যুৎ বিল অনেক কম আসে। আমি দিনের বেলা মেশিন ছাড়ি না। দিনে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে বেশি। সন্ধ্যার পর থেইক্যা ভোর পর্যন্ত পানি দেই।” তিনি আরও বলেন, “সারা রাতের মধ্যে আমার একবারও জমির কাছে আসতে হয় না। প্রতিটি জমিতে পরিমাণ মতো পানি ভরা থাকে। তাছাড়া এইভাবে জমিতে পানি দেওয়ার কারণে মাটির নিচের পানিও উঠে কম, পানির অপচয় হয় না”। তার এই পদ্ধতি অনুসারে আর কেউ পানি সেচ দেয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই গ্রামেরই আরেকজন কৃষক এবছর চোঙ্গা পদ্ধতি চালু করেছে। অনেকেই এসে দেখে যায়। সবাই ভালো বলে”।
অন্যান্য সেচ মেশিনের সাথে খরচের পার্থক্য
সাধারণত দেখা যায় কোন কোন সেচ মেশিন দিয়ে প্রায় সারাদিন ধরে পানি দিতে হয়। মাসিক বিদ্যুৎ বিল আসে প্রায় ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। আর খায়রুল ইসলাম এর এক মাসের বিল এসেছে ২৯৪০ (দুই হাজার নয়শত চল্লিশ) টাকা। মৌসুম শেষে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিল আসে। প্রতি কাঠা জমিতে পানি দেওয়ার মূল্য বাবদ একজন কৃষক ৫’শ টাকা প্রদান করেন। বিদ্যুৎ বিল দেয়ার পর বাকি টাকা লাভ থাকে। এতে করে একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় অন্যদিকে তেমনি বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও পানির অপচয় রোধ হয়।
পরিশেষে
ভূগর্ভে যত পানি মজুদ আছে তার এক তৃতীয়াংশই মানুষের কর্মকা-ের কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেচ কাজের জন্য যে পরিমাণ পানি প্রতিবছর উত্তোলন করা হচ্ছে সে পরিমাণ ভূগর্ভে সঞ্চিত হচ্ছে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হওয়া, অতিরিক্ত খরা ইত্যাদি কারণে কৃষক বাধ্য হচ্ছেন ভূগর্ভের পানির সাহায্যে সেচ দিতে। কারণ এখন আর পানি তোলা ছাড়া ধান চাষ হয় না। ধান চাষের মৌসুমটাকেও বদলে দিয়েছে এই সেচ ব্যবস্থা। অত্যধিক মাত্রায় পানি উত্তোলন এবং বাষ্পীভবন হওয়ার কারণে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বাড়ছে। অনেক গভীর থেকে পানি উত্তোলন করায় এ সময় টিউবওয়েলে পানি উঠে না। কৃষক খায়রুল ইসলামের মতো আমাদের দেশের অনেক কৃষকই ভূগর্ভের পানির সীমিত উত্তোলনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়, পানির অপচয় এবং পরিবেশের বিপর্যয় রোধে ভূমিকা রাখতে পারেন।