অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ভরসার জায়গা ধাত্রী মর্জিনা খাতুন
শ্যামনগর,সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান
প্রথমবার মা হওয়ার সময় প্রত্যেক নারী অজানা শঙ্কায় থাকেন। প্রসবের দিন যত এগিয়ে আসে, ততই তার দুশ্চিন্তা বাড়ে। কিন্তু মর্জিনা খাতুনের মতো একজনের সহায়তা পেলে কোন শঙ্কাই কাবু করতে পারে না প্রসূতি নারীদের। নিরাপদে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত নারীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সাহস দিয়ে পাশে থাকেন। এখন পর্যন্ত ১৫শ’ বেশি সন্তান প্রসব হয়েছে মর্জিনা খাতুনের হাতে। সংগ্রামী জীবন ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার স্বীকৃতি হিসেবে এখন পর্যন্ত কোন সম্মাননা মর্জিনা খাতুন পাননি।
মর্জিনা খাতুনের (৬৭) বাড়ি শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি গ্রামে। তার স্বামী মৃত: ওয়াজেদ আলী গাজী ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক। মর্জিনা খাতুনের ছোট বসতঘরটি দোচালাবিশিষ্ট। ঘরের মেঝে কাঁচা ও স্যাঁতসেঁতে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় দুপাশে জীর্ণ দুটি ছোট খাট। এক পাশে একটি শোকেস। এর ভেতরে কাচের কিছু তৈজসপত্র ও কাপড় রয়েছে। ছেলে, বৌমা ও পুতা ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকেন। মর্জিনা খাতুন একজন প্রশিক্ষিত ধাত্রী। ৩৫ বছর ধরে গ্রামের নারীদের সন্তান প্রসবে সহায়তা করেন। এ জন্য তিনি কোন পারিশ্রমিক নেন না। আপদ-বিপদ, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও তিনি ছুটে যান প্রসূতি নারীদের সমস্যায়। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের কাছে মর্জিনা খাতুন নামটি ভরসার জায়গা।
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ১০-১২ জন গৃহবধূর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্তান জন্মের সময় তাদের প্রত্যেকের পাশে ছিলেন মর্জিনা খাতুন। মর্জিনা খাতুনের সঙ্গে তাদের রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। সন্তান জন্মের সময় সহায়তা করার কারণে মর্জিনা খাতুনের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছে। এই বিষয়ে মর্জিনা খাতুন জানান, ৩৫ বছর আগে পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদে তিন মাস ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তখন থেকে নিজের এলাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সহায়তা করতে থাকেন। এখনও তিনি সেই কাজ করে চলেছেন। তার হাতে প্রায় ১৫শ’ নবজাতকের জন্ম হয়েছে।
মর্জিনা খাতুন বলেন, “সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সুষম খাবার খেতে বলি। শারীরিক কোন সমস্যা দেখা দিলে তাদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সন্তান প্রসবে সহায়তা করি। কোন জটিলতা দেখা দিলে প্রসূতিকে সরাসরি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
কামালকাটি গ্রামের গৃহবধু কমলা রাণী মন্ডল বলেন, “প্রথমবার মা হওয়ার সময় প্রত্যেক নারী শঙ্কায় থাকেন। কিন্তু মর্জিনা খাতুন আপার মতো একজনের সহায়তা পেলে কোনো শঙ্কাই আর থাকে না।” পাখিমারা গ্রামের গৃহবধূ রুনা পারভিনের ৪৫ দিন আগে সন্তান হয়েছে। তিনি বলেন, “মর্জিনা খাতুন আপার সহায়তায় সুস্থ সন্তান জন্ম হয়েছে। আপদ-বিপদ, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও তিনি ছুটে আসেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য যেন এক আশীর্বাদ।”
কামালকাটি,পাখিমারা, ঝাঁপা, সোনাখালী গ্রামের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমবার মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা হলে বাবার বাড়িতে অবস্থান করেন। যেহেতু মর্জিনা খাতুন রয়েছেন তাই বেশির ভাগ পরিবার চিন্তামুক্ত থাকে। কারণ সন্তান জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রসূতি নারীদের পরামর্শ ও খোঁজ রাখেন। এখন বৃদ্ধ বয়সেও তিনি একইভাবে সেই কাজ করে যাচ্ছেন। শত ব্যস্ততা তাঁকে এই কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
মর্জিনা খাতুন সম্পর্কে স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্য শুক্কুরী রাণী বলেন, “অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সেবায় তিনি নিবেদিতপ্রাণ। এই কাজের জন্য তিনি কোন উপহার নেন না। তবে খুশি হয়ে কেউ কেউ তাকে শাড়ি-কাপড় উপহার দিয়ে থাকেন। তিনি আমাদের গ্রামের গর্বিত নারী। প্রসূতি নারীদের কাছে মর্জিনা খাতুন একটি ভরসার নাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গ্রামীণ সমাজে মর্জিনা খাতুনের মতো নারীদের বিশাল অবদান রয়েছে। এ ধরনের মানুষ সমাজের নিঃস্বার্থ উদাহরণ। তবে মর্জিনা খাতুনের এই কর্মের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তাহলে তার মত আরও নারী মানুষের সেবায় এভাবে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত হবে।”