বীজঘরের বীজ দিয়ে পরস্পরের সাথে বিনিময় করছেন নারীরা
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
স্থানীয় জাতের বীজ গ্রামীণ নারীর সম্পদ। গ্রামীণ নারীরা নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সবজি ফসল চাষ, পরিচর্যা বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে থাকে। ভালো ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ বীজে ভালো ফসল হয়। গ্রামাঞ্চলে অনেক নারী আছেন, যারা বসতভিটার পতিত জমি ব্যবহার করে বছরব্যাপী সবজি চাষ করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে থাকেন। আবার এমনও কোন নারী আছেন যাদের বসতভিটায় প্রচুর জায়গা থাকা সত্বেও তারা কোনদিন কোন বীজ রোপণ করেননি। এমন নারীদের উৎসাহিত করে সবজি চাষের মাধ্যমে বসতভিটার সুষ্ঠু ব্যবহার, বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময় প্রথা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব তৈরি করে বীজের বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধি, পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, সংসারের বাড়তি আয় বৃদ্ধি ও নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে নেত্রকোনা জেলায় কেন্দুয়া উপজেলা আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামের সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন সাংগঠনিক উদ্যোগে গড়ে তুলেছে গ্রামীণ বীজঘর।
বীজঘরটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন অভিজ্ঞ গ্রামীণ কৃষাণী রোকেয়া আক্তার। রোকেয়া আক্তারের বসতভিটাসহ মোট জমির পরিমাণ ১০ শতাংশ। বাড়তি কোন জমি না থাকলেও তিনি অন্যের পুকুর পাড়ে ও বসতভিটায় নিজ উদ্যোগে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেন। প্রতি মৌসুমে চাষকৃত সবজির বীজ নিজে উৎপাদন করে বীজঘরে সংরক্ষণ করেন। নিজের জমিতে যেসব জাতের সবজি ফসল তিনি চাষ করেন না, সেসব জাতের বীজ অন্য কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বীজঘরে সংরক্ষণ করেন। বৈচিত্র্যময় বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণকারী সংগঠনের সহযোগিতায় নিজের ঘরেই গড়ে তুলেছেন বীজঘর। রোকেয়ার স্বপ্ন এখন বৈচিত্র্যময় ফসলের যাদুঘর করা। সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন ও বারসিক রোকেয়ার এ স্বপ্নকে সফল করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছেন।
রোকেয়ার বীজঘরে বর্তমানে যেসব ফসলের বীজ সংরক্ষিত আছে তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মৌসুমের সবজি ও ধানের বীজ। আমন মৌসুমের ৮ জাতের ধান বীজ, দুই জাতের ডাল, ৪ জাতের মসলা, ৮ জাতের শিম, ৭ জাতের মরিচের বীজ। এলাকায় বীজ বৈচিত্র্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ-শ্যামল কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবছর গ্রামীণ বীজ মেলা ও স্থানীয় জাতের বীজ বিনিময় উৎসবের আয়োজন করা হয়। বীজ বিনিময় উৎসবের মাধ্যমে আশুজিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে পারস্পারিক সর্ম্পক স্থাপন, সম্পর্ক উন্নয়ন ও পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি, বীজ বিনময় প্রথার পুনরায় চালুকরণ এবং কৃষি ক্ষেত্রে বীজের সমস্যা সমাধানের বীজঘর বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। বীজ বিনিময় উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে সংগঠনটি নিজ গ্রাম ও অন্যান্য গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মাঝে ধানসহ সকল সংরক্ষিত জাতের বীজ বিনিময় করেন। গ্রামের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত বীজের উদ্বৃত্ত বীজ বীজঘরে সংরক্ষণ করে অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য জমা রাখেন।
বীজ সংরক্ষণ ও বীজ বিনিময়ের ফলে গ্রামের নারীদের মাধ্যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের রোকেয়া আক্তারকে অনুসরণ করে গ্রামের প্রায় সকল নারী এখন তাদের উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করছেন এবং প্রয়োজনে রোকেয়ার সাথে পরামর্শ করে বীজঘরে বীজ জমা রাখছেন। গ্রামের সকল নারী বাড়ির আঙিনা ও বসতভিটায় সাধ্যমত সবজি চাষ করছেন। সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ নগুয়া গ্রামে সহজলভ্য হওয়ায় প্রতি মৌসুমে বসতভিটায় সবজি চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান গ্রামের একজন কৃষক ও সংগঠনের উদ্যোগক্তা আবুল কালাম।
নগুয়া গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা পরস্পরের জমিতে ফসল দেখে পরস্পরের নিকট থেকে পছন্দের ফসলের জাতের বীজ সংগ্রহ করছেন এবং নিজ নিজ চাষকৃত ফসলের বীজ অপরকে দিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী বীজ বিনিময় প্রথা নগুয়া গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে নতুন করে আরম্ভ হয়েছে এবং এলাকায় বীজ বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ চর্চা এবং বীজ বিনিময় প্রথা পুনরায় চালুর ফলে এলাকায় বৈচিত্র্যময় ফসলের বীজের সহজলভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। নগুয়া গ্রামের কৃষকরা এখন বীজের জন্য অনেকটাই বাজারের উপর নির্ভর করেন না। গ্রামের কৃষকরা কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা এবং সামাজিক সমস্যা নিজেরাই পরস্পরের পরামর্শ ও সহযোগিতায় সমাধান করতে সক্ষম।
নগুয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন নগুয়া গ্রামের বীজ সমস্যাসহ কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। এ কৃষক সংগঠনের ন্যায় দেশের সকল গ্রামের কৃষকরা সংগঠিত হয়ে নিজেদের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসলে কৃষদের যেমন সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বাজার ও কোম্পানির উপর তাদের নির্ভরশীলতা দিন দিন হ্রাস পাবে। কৃষক ও কৃষি হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কৃষি হবে টেকসই এবং সুনিশ্চিত হবে মানুষসহ সকল প্রাণের জন্য নিরাপদ খাদ্যের।