সাতক্ষীরায় হারিয়ে যাচ্ছে ‘গরুর গাড়ি’

আসাদ রহমান, সাতক্ষীরা থেকে

সাতক্ষীরায় ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম গ্রামের গরুর গাড়ি। সাতক্ষীরার ৭ উপজেলার সকল জনপদে এক সময় দেখা মিলতো গরুর গাড়ি কিন্তু এখন আর গ্রামগঞ্জে আগের মতো চোখে পড়ে না এই বাহনটি।

Satkhira Cow Car photo (1)

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা রাজার বাগান, মাছখোলা এলাকা, ধুলিহর, কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া, যুগিখালী, কয়লা, লাঙ্গলঝাড়া, আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা, তালা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়, শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকায় এবং কালিগঞ্জসহ জেলার ৭৮ ইউনিয়নের সকল গ্রামের মেঠোপথে দেখা যেত গরুর গাড়ি। ছিল সর্বত্র এই গরুর গাড়ির মর্যাদাও। দু’টি গরু দিয়ে পিছনের গাড়ি চলতো ‘ঠাই ঠাই’ করে। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অন্য কোন অনুষ্ঠানে মানুষ বহনের জন্য ‘ছই ওয়ালা’ গরুর গাড়ি ছাড়া যেন কল্পনাই করতে পাতেন না এইসব গ্রামের মানুষ। মানুষ পরিবহনের পর গরুর গাড়ি হরহামেশা ব্যবহৃত হতো মাঠের ফসল আনা-নেয়ার কাজে। সেটাও যেনো এখন বিলুপ্তপ্রায় আধুনিকতা আর যান্ত্রিক বাহনের কারণে। এমনকি ফসল কাটার পর ফাঁকা মাঠে গরুর গাড়ির প্রতিযোগিতা হতো- গাড়ি নিয়ে কার গরু আগে যায় দেখার জন্য। সেই বিশেষ প্রতিযোগিতাও এখন তেমনটা আর দেখা যায় না।

জানা গেছে, বাঁশ আর বাঁশের চটা দিয়ে পিছনের ফ্রেম তৈরি করে গরুর গাড়ি বানানো হতো। সেই গাড়ির চাকার জন্য কামারের কাছ থেকে লোহার পাত সংযুক্ত করা হতো। শতভাগ জ্বালানিবিহীন ও পরিবেশবান্ধব গরুর গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে কোন খরচ হতো না। শুধু গাড়ি বহনের দু’টি গরুর পিছনে যা খরচ হতো। আবার সেই গরুও বিক্রি করে আর্থিক লাভবান হওয়া যেতো।

কলারোয়া চন্দনপুর গ্রামের ৮০ উর্দ্ধো বয়সী নজরুল ইসলাম বলেন, “কলারোয়া উপজেলায় এক সময় গরুর গাড়ি চলত প্রতিনিয়ত। কিন্তু এখন এই সব জনপদে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই গরুর গাড়ি। অবশ্য এখনো মাঝে মধ্যে গ্রামাঞ্চলগুলোতে দুই-একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়ে। কিন্তু সেগুলোর অবস্থাও নাজুক।”

সদর উপজেলার রাজার বাগান এলাকার প্রবীণ আব্দুল হামিদ বলেন, “আজ শহরের ছেলে মেয়েরা তো দূরের কথা, গ্রামের ছেলে মেয়েরাও গরুর গাড়ি যানবাহনটির সাথে খুব একটা পরিচিত নয়। আগে অনেকেরই গরুর গাড়ি ছিল উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।” কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের মুনছুর আলী বলেন, “আমার বাবা দাদারা গরুর গাড়ি চালিয়ে উপার্জন করে আমাদের বড় করেছেন। এই আধুনিক যুগে গরুর গাড়ি নেই, আছে অটো বা ইঞ্জিন চালিত যানবাহন। মানুষের গরুর গাড়ির ওপর চাহিদা নেই।”

তিনি আরও বলেন, “আগে মালামাল বহন করার জন্য গরুর গাড়ির বিকল্প ছিল না। শুধু মালামালই নয়, বিয়ের জন্য বা আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার একমাত্র ভরসা ছিলো গরুর গাড়ি। মাঠের ফসল বহনের জন্য গরুর গাড়ির বিকল্প ছিল না, যদিও যতসামান্য সেটা এখনো দেখা যায়। এমনকি ফসল কাটার পর ফাঁকা মাঠে গরুর গাড়ির প্রতিযোগিতা হতো- গাড়ি নিয়ে কার গরু আগে যায় দেখার জন্য। সেই বিশেষ প্রতিযোগিতাও এখন তেমনটা আর দেখা যায় না।”

Satkhira Cow Car photo (2)

শ্যামনগরের সিরাজুল ইসলাম বলেন, “বর্তমানে আমরা নিজেদের ব্যবহারের জন্য মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার বা মাইক্রো ক্রয় করি ঠিক তেমনি কয়েক যুগ আগেও গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন লোকজন ও গৃহস্থরা গরুর গাড়ি নিজের ব্যবহারের জন্য তৈরি করে বাড়িতে রাখতেন। বিপদে তা তারা বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন সেটা। মাঝেমধ্যে তা আবার ভাড়াও দিতেন।”

এখন গরু আছে কিন্তু গাড়ি নেই। গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি হতে চলেছে। পহেলা বৈশাখসহ বছরের দুই একটি উৎসবে এই গরুর গাড়ি দেখা যায়। পরিবর্তনের যুগে এসে গ্রাম বাংলার সেই জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।

happy wheels 2

Comments