বাউল শিল্পী হেলিম সরকার’র আত্মকথন
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
বৈচিত্র্যময় মাছের জন্য বিখ্যাত হাওর বেষ্টিত নেত্রকোনা অঞ্চল। শুধু মাছই নয়, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্যও নেত্রকোনা অঞ্চলটি সর্ব পরিচিত। এ অঞ্চলের মাটিতেই জন্মেছেন মধ্য যুগের অন্যতম লোক কবি কষ্ক, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত পালাকার মনসুর বয়াতি, কবিয়াল বিজয় আচার্য, মদন মোহন আচার্য, ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক চন্দ্র কুমার দে, মরমী বাউল সাধক জালাল খাঁ ও রাফিল বাউলের মত অসংখ্য লোকজ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এসব লোক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিগণ যুগ যুগ ধরে তাদের লেখনি ও কন্ঠের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য যেমন বিশ্বের নিকট তুলে ধরেছেন, তেমনি মানুষকে বিনোদন দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে আসছেন। এসব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিগণ তৈরি করে গেছেন তাদের সুযোগ্য অসংখ্য শিষ্য। বর্তমানে তাদের অনেকে বেঁচে না থাকলেও তাদের উত্তরসূরী সুযোগ্য শিষ্যগণ তাদের শিক্ষা ও ধ্যান-জ্ঞানকে প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিকট প্রচার করে যাচ্ছেন। রাফিল বাউল এর বর্তমান প্রজন্মের এমনই একজন গুণী শিষ্য বাউল শিল্পী হেলিম সরকার (৪৫)।
বাউল হেলিম সরকার রাফিল বাউল এর শিষ্যত্ব গ্রহণকাল থেকে গত ২২ বছর ধরে বাউল সাধনা করে আসছেন। যেখানেই গানের আসরে গান গাওয়ার ডাক পড়ে সেখানেই তিনি ছুটে যান এবং বাউল গান গেয়ে সকলকে বিনোদন দিয়ে থাকেন। সংসার জীবনে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বাউল হেলিম সরকার এর চারজনের ছোট সংসার। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনার পর আর্থিক দৈন্যতার জন্য তার আর লেখাপড়া হয়ে উঠেনি। সম্পত্তি বলতে তার বাড়ি ভিটাসহ মাত্র পাঁচ শতাংশ জমি। গানের পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই কৃষি কাজের প্রতি তার বেশ ঝোঁক। তিনি একজন উদ্যোগী কৃষক। বাড়ির চারপাশের এ সামান্য জমিতে তিনি সারাবছর বৈচিত্র্যময় জাতের সবজি চাষ করেন। বাউল হেলিম সরকার আশুজিয়া গ্রামের কৃষক সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য। নিজ উদ্যোগে আশুজিয়া বাজারে তিনি প্রায় সময়ই বাউল গানের আসর আয়োজন করেন। বাউল শিল্পী হিসেবে তিনি এলাকার সকলের নিকট পরিচিত এবং তার লেখা ও গাওয়া গানও সকলের নিকট খুব জনপ্রিয়।
আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে তার বয়স যখন ২২ বছর তখন থেকে তার বাউল গান লেখায় হাতেখড়ি। ২২ বছর বয়সে তিনি পাশ্ববর্তী গ্রামের একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। তার লেখা সকল গান তিনি স্ত্রীর জন্য উৎসর্গ করেন। দিন দিন গান লেখা তার নেশায় পরিণত হয়। অভিজ্ঞ বাউল শিল্পিদের সহচার্যে এসে গান লেখা ও গাওয়ায় তিনি আরও দক্ষ হয়ে উঠেন।
এযাবতকাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ২০০টি গান লিখে সুর ও কন্ঠ দিয়েছেন। তার লেখা গানগুলোর মধ্যে দেহ তত্ত্ব, বিচ্ছেদের গান, ভজন, মরণ বিচ্ছেদ, সাম বিচ্ছেদ, রাই বিচ্ছেদ, সাম্প্রতিক ও শরৎ ঘটনাবলী নিয়ে লেখা গান উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখা ও সুর করা গান এলাকার সকলের নিকট খুবই প্রসংশিত হয়। বাউল হেলিম সরকার দিনের বেলায় কৃষি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন আর রাত জেনে গান লিখে সেগুলোর সুর করেন। গান লেখা এখন তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছে। তাঁর লেখা ৮০টি গান এখন পর্যন্ত বাউল শিল্পী হাবিল সরকার, ইদ্দ্রিস মিয়া, নূরুল আমিন ও বাউল রতন সরকারের কন্ঠে রেকর্ড করা হয়েছে।
বর্তমান প্রজন্মের একজন জয়প্রিয় গীতিকার হিসেবে লোক সংগীত প্রেমী এলাকার জনগোষ্ঠী তাঁকে সম্মান করে ও মর্যাদা দেয়। তাঁর ইচ্ছা নেত্রকোনার লোক শিল্পী ও একজন গীতিকার হিসাবে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করা। এবিষয়ে বাউল হেলিম সরকার বলেন, “আমি লোকজ গানের একজন বড় গীতিকার হিসেবে পরিচিতি পেতে চাই। একজন গীতিকার হিসেবে স্কীকৃতি চাই এবং গীতিকার হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে চাই।”
দেশের আনাচে কানাচে হেলিম সরকারের মতো অনেক লোকজ ও বাউল শিল্পী রয়েছেন, যারা অর্ধাহারে ও অনাহারের মধ্যেও গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চা ও ধারণ করে চলেছেন এবং দেশবাসী ও ভিন দেশে বাঙালি লোক সংস্কতিকে প্রচারের মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ এসব গুণী লোকজ সাংস্কৃতিক কর্মীরা আমাদের সমাজ ও দেশে খুবই অবহেলিত। প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা থেকেও তারা বঞ্চিত। তাই আসুন আমরা সকলেই আর কিছু পারি বা না পারি তাদের যোগ্য সম্মান ও মর্যাদাটুকু অন্তত দেয়ার চেষ্টা করি, তাহলেই হয়তো তারা লোকজ সংস্কৃতি চর্চা, ধারণ ও প্রচারণায় আরও উৎসাহিত হবে। আমাদের লোকজ সংস্কৃতি সারাবিশ্বে পরিচিতি পাবে।