জমিতে খারাপ জিনিস মিশিয়ে মাটি নষ্ট করা উচিৎ নয়- কৃষক আকবর আলী

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

জলবায়ু প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে আর এ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে মানুষের চেষ্টার শেষ নেই। শত প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে গ্রামীণ কৃষক-কৃষাণীরা কৃষি ফসল উৎপাদন করে চলেছেন। বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলসহ প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এদেশের কৃষক-কৃষাণীরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনই একজন সংগ্রামী কৃষক সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের কৃষক আকবর আলী (৫২)।

pic-1
আকবর আলী পেশায় একজন দিনমজুরি ও কৃষক। এক ছেলে এক মেয়েসহ মোট ৪ জনের সংসার। জমিজমা বলতে আড়াই বিঘা জমি যার মধ্যে ৫ কাঠা বসতভিটা এবং ২ বিঘা কৃষি জমি। এ ২ বিঘা কৃষিজমিতে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের ধান, মাছ ও সবজি চাষাবাদ করেন। এ বিষয়ে আকবর আলী বলেন, “আগে এ ২ বিঘা জমিতে শুধুমাত্র ধান চাষ করতাম। তাতে শুধু খোরাকি ছাড়া আর কিছু হতো না। এরপর ২০১১ সালের দিকে উপজেলা কৃষি অফিসের আইসিএম প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং বারসিকের বিভিন্ন আলোচনায় ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে সমন্বিত ফসল চাষাবাদ সম্পর্কে ধারণা পাই। সেখান থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমার এ ২ বিঘা কৃষিজমির মধ্যে ২টি প্লট করে চারপাশে উচু করে বাউন্ডারি দিয়েছি এবং চারিপাশে ড্রেন রেখেছি যাতে করে ড্রেনের মধ্যে মাছ, উপরে ধান ও বাউন্ডারি রাস্তার উপরে সবজি চাষ করতে পারি।”

pic-2
আকবর আলী বলেন, “সমন্বিত চাষাবাদ আমি আমার নিজস্ব জ্ঞান, দক্ষতায় করে যাচ্ছি। মৌসুমভিত্তিক বাঁধের উপরে এবং ভিতরে মাচা তৈরি করে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করি যেমন: লালশাক, পালংশাক, মূলা, পুইশাক, টমেটো, বেগুন, ঢেড়স, শিম, লাউ,ঝিঙা, তরুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, করলা, কুশি, বরবটি, কচুরমুখী, ওল, আদা, হলুদ, সরিষা। ধান চাষ হয় বছরে ২বার করে দুই মৌসুমে আমন ও বোরো মৌসুমে।” তিনি আমনে বি আর ১০ ও ৩০ ও বোরোতে বি আর ২৮ ধান লাগান। বছরে ২ মৌসুমে প্রায় ৭৫ মণ ধান হয় যা সংসারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তিটা বিক্রি করেন।

এছাড়াও ড্রেনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করেন তিনি। মাছের মধ্যে রয়েছে হরিনা, ভেটকে, চিংড়ি, তেলাপিয়া, পারশে, চ্যাং, শোল, কৈ, পুঁটি ও বিভিন্ন ধরনের কার্প জাতীয় মাছ। সারাবছর কোন মাছ কিনতে হয় না তাঁর। আর এ সমন্বিত ফসল চাষের ক্ষেত্রে আকবর আলী হাস-মুরগির বিষ্ঠা, বাড়ির ময়লা আবর্জনা, গোবর, ঘুটে ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, “আমি জমিতে কোন রকমের রাসায়নিক সার ব্যবহার করি না। কারণ ধান ও মাছ একত্রে চাষ করি যাতে মাছের কোন ক্ষতি না হয় সে জন্য প্রতিবছর বসত ভিটায় ও জমি চাষের সময় গোবর, ছাগলের নাদি (বিষ্ঠা), হাঁস ও মুরগির বিষ্ঠা, তরকারির খোসা, ময়লা আবর্জনা গর্ত করে রেখে পচিয়ে সার তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করি।” তিনি মনে করেন, রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে জমির শক্তি বছর বছর কমতে থাকে। তবে জৈব সার দিলে জমির মান ঠিক থাকে। তাই জমিতে খারাপ জিনিস মিশিয়ে মাটি নষ্ট করা উচিৎ নয়।

pic-3
আকবর আলী মাঝে মাঝে তার ফসল ক্ষেতে পানি ম্যাশিনে করে পাতায় ছিটিয়ে দেন এবং পোকা ধরা পাতা কেটে ফেলে দেন ও হাত দিয়ে কিছু পোকা মারেন। এছাড়াও তিনি নিম পাতা, মেহগনির ফল, কেরোসিন ও গুল দিয়ে জৈব কীটনাশক তৈরি করে ¯েপ্র করেন। যেন পোকার আক্রমণ কম হয়।

সম্বনিত কৃষি আবাদের ক্ষেত্রে তিনি স্ত্রী ফরিদা পারভীন সবরকমের সহায়তা পান বলে তিনি জানান। এ গুলোর পাশাপশি সংসারের আর্থিক ন্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আকবর আলী ও ফরিদা বেগম হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, কবুতর পালন করেন। বর্তমানে তাদের ৪টি ছাগল, ২টি হাঁস, ৪টি মুরগি, ২টি গরু এবং ১০টি কবুতর আছে। এইভাবে তিনি সংসারের পুষ্টি চাহিদা ও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

pic-4
সমন্বিত কৃষি কাজ করে সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে বছরে প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করেন বলে জানান আকবর আলী। চিংড়ি চাষের পরিবর্তে সমন্বিত কৃষি কাজ করে লবণাক্ত উপকূলীয় এলাকায় বৈচিত্র্যময় কৃষি ও জীবন জীবিকাকে কিভাবে সমৃদ্ধ করতে হয় সেটাই দেখিয়ে দিলেন কৃষক আকবর আলী। উপকূলীয় এলাকায় অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের পরিবর্তে কৃষি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং জীবন ও জীবিকার বিপর্যয় রক্ষায় কৃষককে বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগসমুহকে স্বীকৃতি প্রদান করে সরকারি ও বেসরকারিভাবে তা সম্প্রসারণ করতে হবে, তাহলে কৃষি বিপর্যয় কেটে উঠতে কৃষকেরা আগ্রহী হবে।

happy wheels 2

Comments