টার্কী পালনে আসে অতিরিক্ত আয়
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
চাটমোহরের মথুরাপুর ইউনিয়নের উথুলী গ্রামের স্বপন বিশ্বাস (৪৫) গাজীপুরের একটি খ্রিষ্টিয়ান মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৮৮ সালে এইচএসসি পাশ করেন। একটি বেসরকারী সংস্থায় ১৮ বছর চাকুরী করার পর এখন স্থায়ীভাবে নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন। নিজের চার বিঘার একটি পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য কয়েক মাস যাবত টার্কী পালন শুরু করেছেন। বাড়ি এবং পুকুর ছাড়া অন্য কোন জমা জমি নেই। এক ছেলে এক মেয়ে তার। ছেলে সুজন বিশ্বাস একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি করছেন। মেয়ে তমা বিশ্বাস শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। তিনি জানান, তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে টার্কী পালন সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। এ সম্পর্কে আলাপ হয় ঢাকার বাড্ডা এলাকার এক ব্যক্তির সাথে। তিনি জানান, ফতুল্লায় গেলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। কৌতুহল নিবৃত্তি করতে না পেরে চলে যান ফতুল্লা। ফতুল্লায় গেলে খোঁজ পান তাঁর পাশর্^বর্তী জেলা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার টার্কী পালনকারী সেলিম সরকারের। সেলিম সরকারের সাথে যোগাযোগ করে গত মার্চ মাসে দুই হাজার পাঁচশ টাকা জোড়া হিসেবে একমাস বয়সী বিশটি আমেরিকান প্রজাতির টার্কীর বাচ্চা ক্রয় করেন। বিশটি বাচ্চাই টিকে যায়। বাচ্চাগুলো ছয় মাস পালনের পর গত সেপ্টেম্বর থেকে বারোটি টার্কী ডিম দিচ্ছে। তিনি আশা করছেন, বছরে একশ চল্লিশটি হারে আট বছর ডিম দিবে টার্কীগুলো। বর্তমান প্রতি হালি ডিমের দাম ছয়শ টাকা। তিনি বলেন, “নিজে ইনকিউবেটরে ডিম থেকে বাচ্চা তৈরি করছি। এ পর্যন্ত আশিটি বাচ্চা উৎপাদন করেছি। দুইশ ডিম ইনকিউবেটরে আছে। আশিটি সাত দিনের বাচ্চা পাঁচশ টাকা পিস হিসবে চল্লিশ হাজার টাকার বাচ্চা বিক্রি করেছি। ইনকিউবেটরের দুইশ ডিমের দাম অন্তত ত্রিশ হাজার টাকা। নয় মাসে এ খাত থেকে আশি হাজার টাকার মতো আয় হয়েছে আমার।” তিনি আরও বলেন, “ডিমগুলো ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করলে এসময়েই এর চেয়ে বেশি আয় হবে। বাড়ির আশ পাশের পুকুর থেকে সংগ্রহ করা কচুরিপানা, রাস্তার পাশে অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠা লতাপাতা, কলমি শাক, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ , নরম ঘাস তুলে এনে এদের খেতে দেই। কখনো কখনো বাঁধা কপি ও লেয়ারের ফিড খাওয়াই। দুই বেলা খাদ্য ও পানি দেই। পনেরো দিন পর পর ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে দেয়া ধানের তুষ পরিষ্কার করি। এ কাজে স্ত্রী পাপিয়া বিশ^াস সব সময় আমাকে সহায়তা করেন।”
স্বপন বিশ্বাস আরো জানান, টার্কীর রোগ ব্যাধী খুব কম। সাতদিন বয়সে এক ডোজ এবং একমাস বয়সে এক ডোজ রানী ক্ষেত রোগের টিকা দেন। স্থানীয় পশু সম্পদ অফিস টিকা সরবরাহ করেন। পরিণত বয়সে এক একটি টার্কীর ওজন দশ বারো কেজি পর্যন্ত হয়। এক একটি টার্কী চার পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। টার্কীর মাংসে চর্বির পরিমাণ কম থাকে। মাংস এবং ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে টার্কী বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে তাই তিনি এলাকার মানুষকে টার্কী পালনে উদ্বুদ্ধ করছেন।
চাটমোহরের মূলগ্রামের তোফাজ্জ্বল হোসেনের ছেলে কামরুল ইসলাম (৩৬) কয়েকমাস যাবত টার্কী পালন শুরু করেছেন। বাড়ির সামনে একটি ওষুধের দোকান রয়েছে তাঁর। দোকানে বেঁচাকেনার পাশাপাশি অতিরিক্ত আয়ের জন্য কি করা যায় এমন ভাবনা থেকে টার্কি পালনের চিন্তা মাথায় আসে তার। কামরুল ইসলাম বলেন, “তিন মাস পূর্বে নাটোরের সুজনের খামার থেকে প্রতি পিস ৬৫০ টাকা হিসেবে ৪০ দিনের ২০টি টার্কীর বাচ্চা কিনি আমি। বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা নেট দিয়ে ঘিরে সেখানেই টার্কীগুলো পালন করছি। দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছে টার্কীগুলো। সাড়ে ৪ মাসের মতো বয়স হয়েছে টার্কীগুলোর। এখন ও ডিম দেয়া শুরু করেনি।” তিনি আরও বলেন, “আশা করছি ৬ থেকে ৭ মাস বয়স হলেই টার্কীগুলো ডিম দেয়া শুরু করবে। কচুরিপানা, ধান, গম ও ভুট্টা খেতে দেই টার্কীকে। এক একটা টার্কীর পেছনে প্রতিদিন খাদ্য বাবদ খরচ হচ্ছে ৪ টাকার মতো। খাদ্যের শতকরা ৭০ ভাগই ঘাস লতাপাতা। আশা করছি শীঘ্রই বড় আকারের টার্কী খামার গড়ে তুলব।”
চাটমোহরের বোঁথর গ্রামের সোহেল রানা টুটুল পেশায় একজন ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধি। চাকুরির পাশাপাশি অতিরিক্ত আয়ের জন্য তিনি নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন টার্কী খামাড়। টুটুল বলেন, “এখন থেকে ৬ মাস পূর্বে নাটোর থেকে প্রতিটি ৪ হাজার টাকা হিসেবে আমি ডিম দেবার উপযোগি ৫টি টার্কী কিনি। এক মাস পালনের পর থের্কে টার্কীগুলো ডিম দেয়া শুরু করে। পরে অন্যান্য জাতের আরো কিছু টার্কী কিনি। এখন আমার খামারে আমেরিকান, হোয়াইট হল্যান্ড ও দেশী জাতের ৩০টি বড় টার্কী রয়েছে। দুই মাসে আমার বিনিয়োগের অর্ধেক টাকা উঠে যায়। এখন সম্পূর্ণ লাভ জনক অবস্থায় আছি।” তিনি আরও বলেন, “একটি ভ্যাকসিন প্রয়োগকৃত ৪ দিনের বাচ্চা ৪শ’ টাকা করে এবং ১০ দিনের বাচ্চা ৫শ’ টাকা করে বিক্রি করছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার টাকার টার্কীর বাচ্চা বিক্রি করেছি। এছাড়া কয়েক দিনের মধ্যে আরো বেশ কিছু ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। সপ্তাহে শতাধিক ডিম পাচ্ছি। প্রতি হালি ডিম বিক্রি করছি ছয় থেকে সাতশো টাকা। সখের বশে টার্কী পালন শুরু করলেও এখন এটাকে খুব লাভজনক মনে হচ্ছে।”
টার্কী পালন সম্পর্কে চাটমোহর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. স্বপন চন্দ্র দেবনাথ জানান, চাটমোহরে এখনো বাণিজ্যিকভাবে টার্কী পালন শুরু হয়নি। তবে স্বল্প পুঁজি নিয়ে যে কেউ টার্কী পালন শুরু করতে পারেন। চাটমোহরে নতুন হলেও বেশ কিছু আত্মপ্রত্যয়ী বিভিন্ন বয়সী মানুষ শুরু করছেন টার্কী পালন। এটি বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। টার্কীর মাংস উন্নত মানের ও স্বুসাদু। কোলষ্টোরেলের পরিমাণও কম। ইতিমধ্যেই মাংসের চাহিদা পূরণে টার্কী ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।