সবুরার জীবন জীবিকায় ভূমিকা রাখছে খরগোশ
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
দুপুরের প্রখর সূর্যতাপ উপেক্ষা করে চাটমোহর পৌর সদরের প্রধান সড়ক ধরে হাটছিলেন সবুরা খাতুন। পঞ্চাশোর্ধ বয়সী সবুরার ডান হাতে লোহার শিকের খাঁচায় ভরা কয়েকটি খরগোশ। বাম হাতে আরেকটি খরগোশ শরীরের সাথে আঁকড়ে ধরে ছিলেন তিনি। বোরকা পরিহিতা পৌঢ় সবুরা খাতুন যখন উপজেলা পরিষদের সামনে দিয়ে হেটে ফেরী করে খরগোশ বিক্রি করছিলেন তখন অনেকেই ব্যস্ত রাস্তায় তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন দর দাম। ডাক দিতেই ফিরে তাকান সজাগ সবুরা খাতুন। হাটতে হাটতে ক্লান্ত সবুরা খাতুন ক’পা পিছিয়ে এসে শোনান তার পোড় খাওয়া জীবনের গল্প। যে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে আছে অপ্রাপ্তি আর হতাশার কথা। যে জীবন বেদনা বিদূর। যে জীবন ঘীরে আছে স্বপ্নের লুকোচুরি। এ যেন প্রত্যাশা প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির এক গল্প সম্ভার।
আর দশটা মেয়ের চাইতে সবুরার জীবনটা আলাদা। বসবাস করছেন চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের নটাবাড়িয়া গ্রামে। দশ বছর বয়সে তার পিতা ছকির উদ্দিন তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। জীবন সংসার কি তা তখন অজানা তার। বিয়ে হয় পাশর্^বর্তী করকোলা গ্রামের আশু প্রাং এর সাথে। আশু প্রাং এর প্রথম স্ত্রী ফাতাসী খাতুনের সন্তানাদী হতো না। সন্তানের আশায় তিনি এখন থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে সবুরাকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। দশ বছর বয়সে সতীনের সংসারে পা রাখেন সবুরা। বিয়ের পর প্রায় ১৫ বছর সংসার করেন। এর মধ্যে সবুরা জন্ম দেয় আসিয়া খাতুন, মোসলেম উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন নামক তিন সন্তান। সুখে দুঃখে স্বামী, সতীন, সন্তানাদী সবাইকে নিয়ে ভালই কাটছিল দিনকাল। সবুরার তিন সন্তান জন্মের পর সতীন ফাতাসীরও সন্তানাদী হতে শুরু করে। এরই মধ্যে সবুরা মিতা খাতুন নামক অপর এক মেয়েকে জন্ম দেয়। শুরু হয় সতীনে সতীনে ঝগড়া বিবাদ। কমে যায় আশু প্রাং এর ভালবাসা। সবুরা করকোলা গ্রাম থেকে চলে আসেন পিত্রালয় নটাবাড়িয়া গ্রামে। সেই থেকে বাবার জমিতে ঘড় তুলে সেখানে বসবাস করছেন। বড় মেয়েকে দশ হাজার টাকা যৌতুকে শাহজাদপুর এলাকায় বিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় সন্তান কৃষি শ্রমিক মোসলেম নটাবাড়িয়া গ্রামেই বিয়ে করেছেন। সস্ত্রীক শ^শুড় বাড়িতে থাকেন। তৃতীয় সন্তান আনোয়ারও কৃষি শ্রমিক। গৌড়নগর গ্রামে বিয়ে করে স্বস্ত্রীক শ^শুর বাড়িতে বসবাস করছেন। ছোট মেয়ে মিতার বয়স এখন সতেরো বছর। উত্তরসেনগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী মিতা। স্বামী এবং দুই সন্তানের কেউই কোন খরচাদী দেয় না সবুরাকে। মিতা আর সবুরা একত্রে আছে এখন। সবুরার নিজের স্বপ্ন গুলো বিবর্ণ হয়ে গেলেও স্কুল পড়–য়া মিতাকে নিয়েই এখন তার স্বপ্নের জগত। মেয়েটাকে পড়া লেখা করাতে চান সবুরা। আশু প্রাং এর সাথে এখনো আইনগত বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি তার।
সবুরার স্বামী এখন বৃদ্ধ। পৃথক সংসার তার। ছেলেদেরও পৃথক সংসার। মিতা ও সবুরার সংসারের ঘানি টানার কেউ না থাকায় সবুরাকেই টানতে হয় এ সংসারের ঘানি। তাইতো জীবনের প্রয়োজনে খেয়ে পরে বাঁচতে মিতার বই পুস্তক পড়া লেখার খরচসহ অন্যান্য খরচ যোগাতে জীবনের শেষ দিকে এসেও কাজ করতে হয় সবুরাকে। কখনো অন্যের বাড়িতে মাটি কাটেন। কখনো করেন রাজমিস্ত্রীর যোদগানদারের কাজ। আবার কখনো মাঠে কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। এখন বয়স অধিক হয়ে যাওয়ায় এসকল কাজ করা তার পক্ষে কষ্টদায়ক হয়ে পরেছে। তবুও কয়েক বছর যাবত কাজের পাশাপাশি বাড়তি কিছুটা আয়ের জন্য খরগোশ পালন করে আসছেন তিনি। এ খরগোশ পালন ভূমিকা রাখছে তার জীবন জীবিকায়।
সবুরা বলেন, “পাঁচ বছর আগে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ভিটা গ্রামে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাই। সেখানে তাদের খরগোশ পালন করতে দেখি এবং এটি লাভজনক শুনে বাড়তি আয়ের আশায় খরগোশ পালনের চিন্তা আমার মাথায় আসে। পাঁচশো টাকায় আমি সেখান থেকে এক জোড়া খরগোশ কিনে আনি। এখন মাঝে মধ্যে মাঠের কাজ করি আর খরগোশ পালন করি। বাড়িতে ২২ টি পর্যন্ত খরগোশ হয়েছিল। এখন ৭ টি খরগোশ আছে। প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার বাচ্চা বিক্রি করি। প্রতি জোড়া খরগোশের বাচ্চা তিন থেকে চারশো টাকা বিক্রি করি। অনেকে সখ করে কিনে পালন করে। বিভিন্ন রকমের ঘাস, ভূষি, ভাত, শাক সবজি খায় খরগোশ। অল্প খাবার লাগে। এর জন্য বাড়তি তেমন কোন পরিশ্রম নেই। আমার কাছে খরগোশ পালন লাভজনক মনে হয়”।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবত খরগোশ লালন পালন খাদ্য, বাসস্থান, রোগবালাই, মাংসের গুণাগুন বিষয়ে গবেষণা হয়ে আসছে। গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, খরগোশ পালনে স্বল্প জায়গার প্রয়োজন হয়। অন্যান্য প্রজাতির জীবজন্তুর মাংসের চেয়ে খরগোশের মাংসে প্রেটিন, এনার্জি, খনিজ এবং ভিটামিনের পরিমাণ অধিক। এতে কোলেষ্টেরল, ফ্যাট ও সোডিয়াম কম। মাংস সুস্বাদু ও সহজে হজম হয়। দ্রুত বর্ধনশীল। একটি স্ত্রী খরগোশ ৮ টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে সক্ষম। প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটাতে ও দারিদ্র বিমোচনে মানুষ খরগোশ পালন করে ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষ সৌখিন প্রাণী খরগোশ পালন করে দেশে মাংসের চাহিদার একটা অংশ যোগান দিতে পারে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে খরগোশ হতে পারে সম্ভাবনাময় নতুন সংযোজন। বাংলাদেশে বর্তমান ডার্ক গ্রে, ফক্স, ডাচ, নিউজিল্যান্ড সাদা, নিউজিল্যান্ড কালো, বেলজিয়াম সাদা এবং ছিনসিলা প্রজাতির খরগোশ পাওয়া যায়। গভীর লিটার পদ্ধতি ও খাঁচা পদ্ধতিতে খরগোশ পালন করা যায়। পালং শাক, গাজর, মূলা, শসা, শাকের উচ্ছিশাটাংশ, সবুজ ঘাস, চাল, গম, ভুট্রা, লতাপাতা, ভাত খরগোশের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।