কৃষি শিক্ষা গ্রহণে প্রকৃতির পাঠশালা
শ্যামনগর,সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান
কোভিড-১৯ খাদ্যের চাহিদাকে প্রভাবিত করেছে। মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করায় অনেকেই কম খরচ করছে। ফলে বিক্রির চাহিদা কমে গেছে। খাদ্যের চাহিদা মানুষের আয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। গরিব মানুষের আয় না থাকায় তাদের খাদ্য গ্রহণ কমে গেছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে। এসকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবেলা করে উপকূলীয় অঞ্চলে যে সব অভিজ্ঞ ও দক্ষ কৃষকরা কৃষি কাজ টিকিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বন্যাতলা গ্রামের প্রবীণ কৃষক নওশের আলী সানা (৬৫)একজন।
নওশের আলী সানার বাড়িটি শতবাড়ি হওয়াতে এবং বারসিক থেকে সহায়তা দেওয়ার পর তার জীবনযাত্রায় এবং পরিবারে কি ধরনের পরিবর্তন হয়েছে এবং অন্যরা কিভাবে উপকৃত হচ্ছেন এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিশুকাল থেকেই বাপের সাথে বিলে গরু চরানো, নদী-খালে মাছ ধরা, জমি চাষ করা, ফসল লাগানো, কাটা, মাড়াই, সংরক্ষণ, বাজারে বিক্রিসহ কৃষির যাবতীয় কাজে হাতেখড়ি হয় আমার। কিন্তু বর্তমানে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, লবণাক্ততা ও নোনা পানি প্রবেশ ইত্যাদির কারণে শুধু কৃষিই নয়, মানুষের চিরচেনা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও ব্যাহত হচ্ছে। নোনা পানি ও লবণাক্ত মাটির সাথে সংগ্রাম করে সারাবছর বসতভিটায় লালশাক, মিষ্টিকুমড়া, ঢেঁড়ষ, ঝিঙ্গে, তরুল, বরবটি,লাউ,চালকুমড়া, ধুন্দল, পুঁইশাক, ডাটাশাক, মানকচু, টমেটো, ঝাল, ওল, বিটকপি, ওলকপি, পাতাকপি, কচুরমুখী, সিম, মৌরী, পিয়াজ, রসুন, আদা চাষ করি। চাষ করা শাকসবজি থেকে বিভিন্ন বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করি। তাই চাষবাসের সময় বীজের জন্য চিন্তা করতে হয় না। বরং আমার সংরক্ষিত বীজগুলো থেকে নিজে চাষ করি এবং অন্যদের মাঝে বিতরণ করি। এই বর্ষা মৌসুমে ১২ জনকে ধুন্দল, ঢেঁড়ষ, ঝিঙ্গে, পুঁইশাক, লালশাক ও ডাটাশাকের বীজ সহায়তা করেছি। শাকসবজি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলজ ও কাঠ জাতীয় গাছ রোপণ করেছি। আম, ছবেদা, জাম, পেয়ারা, নারকেল, ডালিম, কদবেল, তেঁতুল, খেজুর, মেহেগনি, ফুলগাছ, নিম, খই, কেওড়া, গোল, বাইন, সুন্দরী ও গেওয়া গাছ লাগিয়েছি। বাড়ির ফল খেতে পারছি এবং বছরে ১০/১২ হাজার টাকার কেওড়া ফল বিক্রি করি। বাড়িতে হাঁস ২১টি,মুরগি ১২টি, ছাগল ৫টি আছে। হাঁস এবং মুরগির বাচ্চা উঠিয়ে গ্রামে বিক্রী করি। চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে ধান চাষ করি। বছরে দুইবার চাষ করে যে ধান পাই তাতে আমার সংসারের সারা বছরের চাল হয়েও কিছু ধান বিক্রি করি।’
নওশের আলী সানা আরো বলেন, ‘এখন জমির মাটি নষ্ট (উর্বরতা হ্রাস) হয়ে গেছে। বাজারের বিভিন্ন সার মেরে মেরে মাটির জোঁ সব শেষ। মাটি এখন শক্ত ও ঝিলের মত। কৃষক এখন বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া কৃষি জমিতে নদীর লবণ পানি তুলে চিংড়ি চাষ করার ফলে, কৃষি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। আগে কত রকম শাক, শালুক, ঢাব, ব্যাঙ, কুচে, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক পাওয়া যেত, যা ছিল কৃষির জন্য অনেক উপকারী, সেগুলোও হারিয়ে গেছে। ফসলের অনেক জাত ও এখন আর পাওয়া যায় না।’
তিনি আরো বলেন, ‘বসত ভিটার নীচু স্থানে নোনা পানির নদী থেকে বালি উঠিয়ে ফসল চাষের উপযোগী করার চেষ্টা করছি। বালির উপরে এক ইঞ্চি পুরু করে বিল থেকে মাটি এনে দিয়েছি। জমিতে গোবর ও জৈবসার দিয়ে চাষ করে ধঞ্চে বীজ লাগানো হয়েছে। তার ভিতর দিয়ে ওল এবং কচুরমুখী লাগানো হয়েছে। বাড়িতে জৈব সার তৈরি করি। আমি সারাজীবন জমির মাটিতে বসতভিটার জৈবসার ও আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করি। মানুষের স্বাস্থ্যের মতো মাটিরও স্বাস্থ্য ভালো না রাখলে ফসল ভালো হয় না। কৃষিকে অনেকটা সন্তানের মতো দেখতে হবে। জমিতে ফসল চাষ করে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিদিন ফসল ও জমির সাথে কৃষকের দর্শন হতে হবে। আমার বাড়ির সাথে নদীর চরে অনেক কেওড়া গাছ লাগিয়েছি। তাতে কয়েকশ পাখি বসবাস করে। বিকাল বেলায় পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে খুব ভালো লাগে। আজাবা (বনজ) অনেক শাক, মাছ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান সংরক্ষণ করা দরকার। এতে করে গ্রামের সকল কৃষি পরিবার অনেক বেশি লাভবানসহ কৃষি কাজে আগ্রহ বেড়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে এখন অনেকে পরামর্শ নিতে আসে। আমার কাছে এলাকার অনেক কৃষক কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে যায়। আমার মতে, এ দেশের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হলে, কৃষির সকল উপকরণের উপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। কৃষককে বাজার ও কোম্পানি নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কৃষি প্রাণ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষকের জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যথায়, কৃষি ও কৃষকের প্রাণ বিসর্জন হবে এবং আমরা হবো পরনির্ভশীল।’
কৃষিতে তাঁর সাফল্য এবং কৃষি চর্চায় তাঁর জৈব ব্যবস্থাপনা অন্য কৃষকদের আকৃষ্ট করে তুলছে। কৃষক নওশের আলী সানার কৃষি কাজ অত্যন্ত পরিকল্পিত। কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য তার মতো দক্ষ কৃষকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করতে না পারলে আমরা আস্তে আস্তে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বো। এলাকার অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের কাছে শ্রদ্ধা অর্জনসহ শিক্ষা গ্রহণের এক প্রকৃতির পাঠশালা তৈরি করেছেন।