ডেঙ্গু, বাস্তুসংস্থানের যন্ত্রণা ও প্রতিবেশপ্রশ্ন
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ
প্রশ্নহীনভাবে ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশের জন্য এক জটিল দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এডিস মশাবাহিত এ রোগটি দুম করে এক দুই দিনে এমন লাগামহীন হয়ে যায়নি। মোটাদাগে জনস্বাস্থ্যসেবায় সংকট এবং প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উদাসীনতা ডেঙ্গু বিষয়ে সাম্প্রতিক তর্কের ময়দান দখল করে আছে। আড়াল হয়ে পড়ছে পরিবেশগত সংকট ও বাস্তুসংস্থানের বিশৃংখলার বিষয়গুলো। যতটুকু জানা গেছে, বাংলাদেশে এই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে মূলত: ঢাকা অঞ্চল থেকেই। নিদারুণ পরিবেশ-যন্ত্রণায় কাতর এই মহানগরকে আমরাই প্রতিদিন আমাদের জন্য বিপদজনক করে তুলছি। এই ছোট্ট নগর আর আমাদের দুঃসহ দূষণ ভার সইতে পারছে না। আমরা নির্দয়ভাবে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, তুরাগ ও বালু নদীকে হত্যা করে চলেছি। ঊনিশ খালসহ সকল জলাশয় উধাও করে দিয়েছি। নতুন প্রজন্মের জন্য এক চিলতে ফাঁকা মাঠ কী ময়দান আমরা অবশিষ্ট রাখছি না। এই নগরের ক’টি উদ্যানই বা সুস্থ আছে? অল্প বর্ষাতেই এই শহর ডুবে ভেসে একাকার হয়ে যায়। লাগামহীন নগরবর্জ্যরে যন্ত্রণার ভেতর দিয়েই শুরু হয় আমাদের প্রতিটি ভোর। ভ্যাপসা গরমে এই নগরে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। একের পর এক আগুনে ছাই হয়ে যায় কত সাজানো সংসার। বসতঘরের চারধারে আমরা মজুত করেছি রাসায়নিক বিস্ফোরক, আশেপাশে গড়ে তুলেছি প্লাস্টিকসহ বিনাসী কারখানা। অনেক কষ্টে ট্যানারিকে কিছুটা দূরে সরাতে পেরেছি, কিন্তু তাও আর দূরে কই! একটু প্রাণ ভরে দম নেয়ার জন্যও বিষহীন বাতাস কই এই নগরে? সবদিক দিয়েই ঢাকা আজ এক পরিবেশ-সংকটাপন্ন শহর। আর এই পরিবেশ বিপর্যস্ত অঞ্চল নানা সময়ে নানাভাবে মানুষের জন্য তৈরি করছে দুঃসহ যন্ত্রণা। ডেঙ্গু কী চিকুনগুনিয়া এমনি এক পরিবেশগত তীব্র সংকটের নিদারুণ নির্দেশনা।
ডেঙ্গু মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে প্রতিটি পল বিপল অনুপল। নানামুখী প্রশ্ন ও তর্ক থাকলেও বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করছে ডেঙ্গু মোকাবেলায়। মশকনিধনের নানা প্রক্রিয়া ও তৎপরতা নিয়ে বাহাস চলছে। সকলেই একমত যে, চলমান ডেঙ্গু সংকট মোকাবেলায় আমাদের দরকার এক সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল। পরিবেশব্যবস্থায় সুস্থতা না থাকলে ম্যালেরিয়ার পর চিকুনগুনিয়া এরপর ডেঙ্গু একের পর এক দুঃসহ যন্ত্রণা প্রকট হয়ে ওঠবে। পাশাপাশি জটিল শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, বহুমূত্র, ক্যান্সারসহ জটিল রোগের বিস্তার ঘটবে। ডেঙ্গুকে কেবলমাত্র কোনো এক বছরের মৌসুমি সংকট হিসেবে না দেখে ডেঙ্গুসহ এমনসব জটিল যন্ত্রণা মোকাবেলায় এই প্রসঙ্গসমূহ রাষ্ট্রীয় মূলচিন্তা হিসেবে গ্রহণ করা জরুরি। ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের প্রবল মনস্তত্ত্বে সামগ্রিক পরিবর্তন দরকার। এটি তো এমন নয়, কোনো এক মৌসুমে এডিস মশার বিস্তার বেশি হবে আর মানুষ আক্রান্ত হবে। তারপর আমাদের মশকনিধন ও স্বাস্থ্যসেবা তৎপরতা শুরু হবে। ডেঙ্গুসহ এমনসব নাগরিক যন্ত্রণার মর্মমূলে আমাদের ফিরে তাকানো জরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক প্রশ্ন হলো, ‘মশা কেন বাড়ছে?’ এই প্রশ্নের উত্তর নানাভাবে আমাদের তলিয়ে দেখা জরুরি। আর এর নানামুখী উত্তরই আমাদের সামগ্রিক ডেঙ্গু মোকাবেলার সকল সূত্র সামনে তুলে ধরতে পারে। যা মশাজরিপ থেকে শুরু করে আগাম সতর্ক বার্তা, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, মশক নিয়ন্ত্রণ, সক্রিয় চিকিৎসাসেবাসহ সামগ্রিক নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
২.
নগর কী গ্রাম প্রতিটি অঞ্চলেই এক এক ধরণের প্রাণব্যবস্থাপনা ও বৈচিত্র্যের ব্যাকরণ থাকে। আমরা ঢাকা শহরের প্রাণ ব্যবস্থাপনা ও বৈচিত্র্যের ব্যাকরণ নিয়ে তুমুল উদাসীন। গ্রাম কী শহর প্রতিটি জনপদেই কেবল মানুষ নয়, আরো নানা প্রাণপ্রজাতি থাকে। তৈরি হয় এক ঐতিহাসিক প্রতিবেশসূত্র ও স্বতন্ত্র বাস্তুসংস্থান। এই বাস্তুসংস্থানে নানামুখী খাদ্যশৃংখল তৈরি হয়। যখন কোনো বাস্তুসংস্থানে কোনো একক প্রজাতি নির্বিকারভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং অন্যসকল বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে তবে সেই বাস্তুসংস্থান চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে। বহুমুখী সংকট সেখানে তৈরি হয়। মহানগর ঢাকার ক্ষেত্রে তাই ঘটে চলেছে। এখানে এককভাবে সবকিছু কেবলমাত্র মানুষের জন্য তৈরি হচ্ছে, সকলকিছু এখানে কেবল মানুষের জন্যই। এভাবে কোনো অঞ্চলের স্বকীয় প্রতিবেশসাম্য তৈরি হয় না। প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাকরণ অটুট থাকে না। ঢাকা এখন মানুষ ও এডিস মশার দখলে। এককভাবে এই দুই প্রজাতি ছাড়া অন্যান্য প্রাণপ্রজাতি এখান থেকে বিলীন হয়েছে। আর তাই মানুষ ও মশার এই সংকট আরো জটিল ও তীব্র হয়ে ওঠছে। এখানে প্রাণ-প্রজাতির প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও ভারসাম্যের গণিত ভেঙ্গে পড়েছে। ব্যাঙ, চামচিকা, টিকটিকির মতো প্রাণীরা নেই। যারা মশা খেয়ে মশার সংখ্যা প্রাকৃতিকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতো। মশক নিয়ন্ত্রণে কেবলমাত্র রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের কথাই ভাবা হচ্ছে। যা সাময়িক সংকট সামাল দিলেও এর এটি কোনো দীর্ঘমেয়াদী সুরাহা নয়। মশক নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক সমন্বয় ঘটানো জরুরি। কারণ একতরফাভাবে কীটনাশক ছিটিয়ে মশার লার্ভা কী মশা মেরে মশার সামগ্রিক বিস্তার ঠেকানো অসম্ভব। কারণ মশার ডিম যা কয়েকমাস অবধি জীবন্ত থাকে এবং আবার উপযুক্ত পরিবেশে জন্ম নেয়। এই নগরের প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক খাদ্যশৃংখল ব্যবস্থা সম্পূর্ণত বদলে গেছে। দীর্ঘমেয়াদী সংকটহীন জীবন কাটাতে নগরের এই প্রাকৃতিক খাদ্যশৃংখল ব্যবস্থাকে আমলে নিতে হবে। মশার উপর নির্ভরশীল প্রাণীজগতের সুরক্ষার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। ঐতিহ্যবাহী মধুপুর গড়ের একটি অংশ ঢাকাতে। শালবনের এক অতীত স্মৃতি আছে এই ঢাকার মাটিতে। সতের শতকেও ঢাকার বনাঞ্চলে বাঘ, চিতাবাঘ দেখা গেছে। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৮০৪ সনে ঢাকায় ২৭০টি বাঘের চামড়া এবং ১৯০৭-১৯১০ পর্যন্ত ১৩টি বাঘের চামড়া শিকারীরা জমা দেয়। ১৮৩৭ সাল অবধি প্রতিবছর কমপক্ষে একজন এখানে বাঘের হামলায় নিহত হয়েছে। বনবিড়াল, বনশূকর, বুনোমহিষ, বানর, শেয়াল, গন্ধগোকূল, বেজি, ইঁদুর, সাপ, খরগোশ, সজারু, বাদুড়, চামচিকা, ভোঁদড় আর নানা জাতের পাখির বিচরণ ছিল এই মহানগরে। নিদারুণভাবে সব হারিয়ে এই নগর আজ মানুষ আর মশাকে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
৩.
চলমান ডেঙ্গু সংকট কাটাতে মশা নিয়ন্ত্রণে এখনো পর্যন্ত কেবলমাত্র রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার কথাই আলোচিত হচ্ছে। কিন্ত রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা বিশ্বব্যাপি নানাভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সংকট তৈরি করছে। এককালে আমরা ডিডিটি ব্যবহার করেছি, এই আমরাই আবার ডিডিটি ধ্বংস করতে এক বিশাল প্রকল্প সমকালে হাত নিয়েছি। ২০১৯ সনের ২৮ জুলাই আণবিক শক্তি কমিশনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সভায় বিশেষজ্ঞ কমিটি ম্যালাথিয়ন ৫৭% ইসি, ম্যালাথিয়ন ৫% আরএফইউ, ডেল্টামেথ্রিন + পিআরও ২% ইডব্লিউ এবং প্রিমিফোস-মিথাইল ৫০% ইসি এই চারটি রাসায়নিক কীটনাশককে মশকনিধনে সুপারিশ করে। ডেঙ্গু নিরসনে স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (এসআইটি) প্রসঙ্গও আলোচিত হচ্ছে। এভাবে প্রকৃতিতে কৃত্রিমভাবে বন্ধ্যা পুরুষ মশার বংশ বাড়িয়ে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হতে পারে তা এখনো পরীক্ষিত নয়। তারপরও দেশজুড়ে মানুষ চাইছে রাষ্ট্র সক্রিয় হোক, দ্রুত একটা কিছু করুক। এডিস মশার বংশ ও বিস্তার দ্রুত নির্মূল হোক। যতটা সম্ভব জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশপ্রশ্নকে বিবেচনা করে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার নিয়ম নীতি মেনে দ্রুত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে দীর্ঘমিয়াদী মশক নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই আমাদের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় কর্মপন্থা তৈরি করা দরকার।
৪.
মশা নিয়ন্ত্রণে এবং মশাজনিত অসুখ বিশেষত ম্যালেরিয়া জ্বরের চিকিৎসায় দেশজুড়ে লোকায়ত পরিবেশবান্ধব নানা পদ্ধতি ও চিকিসার চল আছে। কুমুদ সুকুমার ও অন্যান্যরা (১৯৯১) মশক নিয়ন্ত্রণে ল্যামিয়াসি, অ্যাস্টারেসি, ক্ল্যাডোফোরেসি, ম্যালিয়াসি, ওয়সিস্টাসি এবং রুটাসি পরিবারের উদ্ভিদসমূহকে ভবিষ্যতের মশক নিয়ন্ত্রণের কার্যকর সূত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ২০০০ সনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে যখন ঢাকা ও সিলেট বিভাগের ১৪টি আদিবাসী জাতিসত্তার ভেতর জনউদ্ভিদ সমীক্ষা চালাই তখন ৫টি উদ্ভিদকে মশা নিবারক হিসেবে সনাক্ত করি। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণেও এরকম উদ্ভিদজাত লোকায়ত পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণার নজির আছে। বনতুলসি ও সাদা জিওলের পাতা এবং লেবুর খোসা (Kazembe and Chaibva,, ২০১২) এবং নিম পাতা (Maragathavalli et al. 2012) ব্যবহার করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কিছু গবেষণা নজির আছে। প্রত্যুষা কান্টেকি ও আলাপাটি পদ্মা (২০১৭) জানান, উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে মশক নিয়ন্ত্রণে তুলসি, শিরিষের বাকল, নিশিন্দা পাতা, রঙের বীজ, বনপালংয়ের ডগা, তামাক পাতা, ল্যান্টানা পাতা, কাশ ও ছোট আকন্দ গাছগুলো মানুষ মশা তাড়াতে ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণের এমনতর অনেক পরিবেশবান্ধব লোকায়ত পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ডেঙ্গু নির্মূলের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় পরিকল্পনায় এমন পরিবেশবান্ধব লোকায়ত পদ্ধতিগুলো যুক্ত করা জরুরি। এখানে থেকেই পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার বহু সূত্র বেরিয়ে আসবে, যা এক টেকসই ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে পারে।
৫.
বলা হয় জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবে মশাজনিত রোগের বিস্তার বাড়ে। হয়তো চলমান ডেঙ্গু সংকটের সাথে জলবায়ুগত বিপর্যয়ের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী নাগরিক সমাজ কেউ তার দায় বা দায়িত্ব এড়িয়ে যাবে। চলমান ডেঙ্গু সংকট এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যা যন্ত্রণাকাতর নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রের এক দীর্ঘ দূরত্ব তৈরি করছে। আমরা চাই রাষ্ট্র ও নাগরিকের এই দূরত্ব দ্রুত ঘুচে যাবে। রাষ্ট্র সকল জনকে নিয়ে ডেঙ্গু মোকাবেলায় তৈরি করবে এক মজবুত সক্রিয় বলয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার প্রশ্নই হবে যার কেন্দ্রীয় ভিত।