কুঁই: একটি অচাষকৃত উদ্ভিদের সুস্বাদু ফল
:: কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে মাকসুদা বেগম
প্রকৃতিতে প্রাকৃতিকভাবে নানান ধরনের উদ্ভিদ জন্মে। এসব প্রাকৃতিক উদ্ভিদগুলো মানুষের নানা উপকারে আসতে পারে যদি সেগুলোর ব্যবহার জানা যায়। অচাষকৃত এসব উদ্ভিদের খাদ্যপ্রাণ, ওষুধিগুণ, পুষ্টিগুণসহ নানান কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রাচীনকালে মানুষ প্রকৃতিতে থেকেই তাদের বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ খাবার যোগার করতো। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে নানানরকম অচাষকৃত উদ্ভিদ রয়েছে যেগুলো মানুষ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। আদাবরুন/বিলশাক, তেলাকচু, ঘুমশাক, কলমিশাক, গাদামনি শাক, হেলাঞ্চ, মাটিফোড়া শাক, খুদকুড়ো, হাতিশূর, সেঞ্চি শাক, ঘোড়া সেঞ্চি, কাটানটি, গিমে শাক, থানকুনি, কালকচু ইত্যাদি অচাষকৃত উদ্ভিদগুলো মানুষ একাধারে খাদ্য এবং ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে এখনও। হাওরাঞ্চলের এরকমই একটি অচাষকৃত উদ্ভিদের সুস্বাদু ফল হচ্ছে ‘কুঁই’। বাষট্টির মর্মান্তর আর চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে হাওর অঞ্চলের হাভাতে মানুষেরা দিনের পর দিন উপোষে কাটিয়েছে। বাঁচার তাগিদেই তারা ভাতের বিকল্প হিসেবে স্বাদ আর শর্করাযুক্ত ‘কুঁই’ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেন।
“কুঁই” দেখতে অনেকটা বাদামের মত। হাওরের বোরো ধানের জমিতে (শাইল জমি) যেখানে দেশী ধানের চাষ করা হয় সেখানে এ উদ্ভিদের জন্ম হয়। এটি মূলত আলু বা শালুকের মতো মাটির নীচে হয়। মাটির নীচ থেকে তুলে সেটিকে পরিষ্কার করে খাবারের উপযোগী করা হয়। সাধারণত অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত কুঁই সংগ্রহ করা হয়। “কুঁই” একসময় হত দরিদ্রদের খাবার ছিল তবে কালক্রমে দরিদ্র ছাড়াও অনেকের খাদ্য পরিণত হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা, ধর্মপাশা উপজেলা, মধ্যনগর থানার চামরদানী ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের ১৭টি দরিদ্র এখনও “কুঁই” সংগ্রহের সাথে জড়িত। এই গ্রামের মানুষের ভাষ্যমতে, “কুঁই খেতে খুবই সুস্বাদু, এটি সেদ্ধ করে খাওয়া যায়, পিঠা, পায়েসও খাওয়া যায়, সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ভেজে খাওয়া যায়। এটি একটি পুষ্টিকর খাবার।” কুঁই ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। শরীরে ব্যাথা নিরাময়ে এটি বেশি ব্যবহার হতো বলে তারা জানান।
তবে অন্যান্য অচাষকৃত উদ্ভিদের মতো কুঁইও বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। জমি চাষ করার ফলে এ অচাষকৃত উদ্ভিদ মরে যাচ্ছে বা সেগুলোকে তুলে ফেলা হচ্ছে খুব ছোট থাকতেই। বাণিজ্যিকভাবে ফসল চাষ করায় মানুষ আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হচ্ছে। তাই মূল ফসলকে রক্ষার জন্য অনেকসময় অচাষকৃত উদ্ভিদগুলোকে হত্যা করা হয়। এছাড়া কীটনাশক ব্যবহারের কারণেও কুঁইসহ অন্যান্য অচাষকৃত উদ্ভিদগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে ফসলের মাঠের কুঁই এবং অন্যান্য কুড়ানো শাক ও উদ্ভিদ আর থাকছে না। তাই কুঁইসহ অন্যান্য অচাষকৃত উদ্ভিদগুলোকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে হবে।