এইখানে একদিন নদী ছিল
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সব নদী এখন মৃত। দীর্ঘ বাঁক নিয়ে জেলার এক পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পদ্মা-যমুনা নদী। এই বড় দু’টি নদীর শাখা নদীগুলোই প্রবাহিত হয়েছে জেলার অভ্যন্তর ভাগের বুকচিরে। এর মধ্যে কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদী উল্লেখযোগ্য। এসব নদীতে শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে ৩-৪ মাস পানি থাকে। বছরের বাকি সময় নদীগুলো যেনো মরুময় হয়ে পড়ে। বিশেষ করে চৈত্রের শুরুতে বেশির ভাগ নদীর আশিভাগ অংশ পুরোপুরি শুকিয়ে যায়।
মানিকগঞ্জের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীগঙ্গা নদী এখন ধু ধু বালুচর। যতদূর চোখ যায় শুধু বালু আর বালু। যতটুকু পানি আছে তার ওপর দিয়ে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাও চলাচল করতে হিমশিম খায়। লোকজন কাপড় না ভিজিয়েই অনায়াসে নদী পাড় হতে পারে খুব সহজেই।
অথচ একসময় এই কালিগঙ্গার বুকভরা ছিল উচ্ছল যৌবন। সময়ে অসময়ে কূল উপচে পানি পৌঁছে যেতো গৃহকোণে। স্থানীয় অনেকেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, প্রচন্ড ঢেউ, ভয়াবহ স্রোত ও ঝড় তুফানের কথা। মানুষজন ছোটখাটো নৌকা নিয়ে নদী পারাপার হতে সাহস পেতো না। মানুষ ও যানবাহন পারাপারের জন্য ছিল ফেরি, লঞ্চ, স্টিমার ও বড় বড় নৌকা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সমস্ত যানবাহন ও মানুষ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত করতো কালিগঙ্গা নদী পার হয়ে। এই নদী পার হতে গিয়ে বড় বড় ঢেউ এসে নৌকাকে সজোরে ধাক্কা দিলে মানুষের বুকে কম্পন শুরু হতো।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মানিকগঞ্জের তরা কালিগঙ্গা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় বিশাল সেতু। সেতুটি নির্মাণের পর থেকেই ধীরে ধীরে কালিগঙ্গার নদী তার যৌবন হারাতে থাকে। বর্তমানে কালিগঙ্গা নদীর এক পাশে খালের মতো হাঁটু পানির আঁকাবাঁকা লাইন চলে গেছে জেলার গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোনো জেলায়। তবে মানিকগঞ্জ সীমানায় জলহীন মরাকান্নার এই কালিগঙ্গা নদীকে পুঁজি করে মাটি ও বালু কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা জমে উঠেছে। সেই সঙ্গে নদীর সরু পথে যেটুকু পানি রয়েছে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো ড্রেজার বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। ফলে কালিগঙ্গা তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কৃষিজমি ভেঙে যাচ্ছে।
বেসরকারী উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় জানান, কালিগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীরও একই অবস্থা। একসময় ধলেশ্বরী নদী পানিতে ভরপুর থাকতো। এখন এ নদীতে পানির দেখা মেলা ভার। নদী শুকিয়ে ফসলের মাঠে রূপান্তরিত হয়েছে। মানিকগঞ্জের জাগির ব্রিজের নিচে গেলেই দেখা যায় ধলেশ্বরীর মরা কান্না। মাইলকে মাইল শুধু ফসলের মাঠ ।
কয়েকটি শিল্প-কারখানার বর্জ্য পানিই হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীর পানি। বিষাক্ত পানিতে মাছও থাকতে ভয় পায়। ধলেশ্বরীর মতো ইছামতি নদীরও একই হাল। পদ্মা নদীর শাখা ইছামতি নদী এখন অনেকটা পানিশূন্য। হরিরামপুর উপজেলার ইছামতি নদী দিয়ে এক সময় ঐতিহ্যবাহী ঝিটকা হাটের সমস্ত পণ্য নৌকাযোগে আনা-নেয়া করা হলেও এখন সে অবস্থা নেই।
বর্ষা মৌসুম ছাড়া সারা বছরই নদীতে পানি থাকে না। ৩-৪ মাস নৌকার কদর থাকলেও বছরের বাকি সময় নৌকা চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায় পানির অভাবে। সব মিলিয়ে কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও ইছামতির জলহীন মরা কান্না দেখার কেউ নেই।