জলবায়ু নিয়ে জুয়া খেলা
:: পাভেল পার্থ, লা বুর্জ, প্যারিস, ফ্রান্স
এক
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের ২১তম আসর চলছে ফ্রান্সের প্যারিসে। বৈশ্বিক উষ্ণতা দুই ডিগ্রির নিচে রাখবার শর্ত ঘিরে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা। বৈশ্বিক জলবায়ুর সুস্বাস্থ্যের আশায় আইনি বাধ্যবাধকতাসহ একটি চুক্তির দাবি সবার। ১৫৫টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পাশাপাশি প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের আদিবাসী প্রতিনিধি। আমাজন থেকে শুরু করে দ্বীপরাষ্ট্র, আফ্রিকা থেকে এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপ। স্ইুডেন ও নরওয়ের সামি আদিবাসী সংসদের প্রতিনিধিরাও। একটি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা আমাজন অরণ্যনির্ভর আদিবাসীদের অনেকেই সেজেছেন ঐতিহ্যগত সাজে। তুলে ধরছেন জলবায়ু বিপর্যস্ত দুনিয়ায় নিজেদের টিকে থাকবার অবিস্মরণীয় সব আখ্যান। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আদিবাসী ন্যায্যতাকে যুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছেন। চিরাপাক নামের একটি সংগঠন কাজ করেন পেরুর আদিবাসীদের নিয়ে। চিরাপাকের প্রধান ট্রাসিলা রিভেরা জিআ জানালেন, আমাজন অরণ্য নির্ভর আদিবাসীদের টিকে থাকাই এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি আজ। বহুজাতিক কোম্পানির নানা উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি প্রবল রাষ্ট্রীয় অসহযোগিতা সারা বিশ্বের আদিবাসীদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত সমস্যা। দিন দিন বৃষ্টির ধরণ পাল্টাচ্ছে, তাপমাত্রা অনিয়মিত হচ্ছে। ব্যাপকহারে বনভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীরা এই সর্বনাশের জন্য কোনোভাবেই দায়ি না হলেও এর ঝুঁকি সামলাতে হচ্ছে তাদেরই। গুয়াতেমালার ললা কেবনাল কাজ করেন ‘এসোসিয়েশন এক টিনামিট’ নামের এক আদিবাসী সংগঠনে। ললা জানান, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক দেনদরবারে আদিবাসীদের অস্তিত্ব একেবারেই গুরুত্বহীন। অথচ আদিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবেই পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান ও সংস্কৃতির ভেতর এক দারুণ সম্পর্ক তৈরি করে চলেছেন। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেও আদিবাসীদের অধিকারগুলো অনুচ্চারিত থাকছে।
দুই
টেবটেবা ফাউন্ডেশন ‘নলেজ ইনোভেশন এন্ড রেজিল্যান্স : ইন্ডিজেনাস পিপলস ক্লাইমেট চেঞ্জ এডাপটেশন এন্ড মিটিগেশন মেজারস’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করে ২০১২ সনে। নেপাল ফেডারেশন অব ইন্ডিজেনাস ন্যাশনালিটিস এবং সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস পিপলস রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট যৌথভাবে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ইন্ডিজেনাস পিপলস’ বইটি প্রকাশ করেছে ২০১৫ সনে। বই দু’টি মূলতঃ দক্ষিণ এশিয় ও আফ্রিকা অঞ্চলের আদিবাসীদের জলবায়ু সংকট মোকাবেলার ধরণকে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, তাঞ্জানিয়া, ক্যামেরুন ও নেপালের আদিবাসীদের জলবায়ু অভিজ্ঞতা দিয়ে বইগুলো সাজানো হয়েছে। জলবায়ু সংকটকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অভিজ্ঞতায় বিবৃত করেছেন নবারুণ চাকমা ও সেঁজুতি খীসা। ক্রান্তিয় বনভূমি এবং উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানের উদাহরণ টেনেছেন তারা। প্রাকৃতিক জলাধার শুকিয়ে যাওয়া, বৃষ্টির ধরণ পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, রোগের প্রাবল্য বৃদ্ধি এভাবেই তারা জলবায়ু সংকটকে বুঝাতে চেয়েছেন। এই সংকট কৃষিনির্ভর পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জীবনযাত্রা ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে প্রভাব তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক রাষ্ট্রীয় নীতি কি উদ্যোগ কোথাও আদিবাসীদের জলবায়ু জিজ্ঞাসাকে জায়গা দেয়নি বাংলাদেশ। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেও বাংলাদেশ আদিবাসীদের জলবায়ু প্রশ্নকে অনুচ্চারিতই রেখেছে। অথচ দেশের প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী সমাজ এখনও মূলত: কৃষি ও জুমনির্ভর উৎপাদন অর্থনীতিকে আগলে আছে।
তিন
বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের মূল সংখ্যাঘনত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম একসময় দুনিয়ার অন্যতম তুলামহল হিসেবে পরিচিত ছিল। এ অঞ্চলই দুনিয়ার বস্ত্রখাতকে বিকশিত করেছে। যার চলতি বিকাশমান রূপ হিসেবে করপোরেট গার্মেন্টস বাণিজ্য হাজির হয়েছে। কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, ভাওয়াল ও মধুপুর গড়ও তুলা উৎপাদন অঞ্চল। টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনের চুনিয়া গ্রামের মিধন চিরান ছিলেন একজন সফল মান্দি খিল (জুম তুলা) উৎপাদক। ১৩৪০ বাংলায় প্রতি সের জমতুলা বিক্রি হতো ১২ আনায়। ১৯৫০ সনে শালবনে রাষ্ট্রীয়ভাবে জুমচাষ নিষিদ্ধকরণের ফলে মধুপুর ও ভাওয়াল অঞ্চলে তুলা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে তুলা উৎপাদন বন্ধ করে আবার সেই ভাওয়াল অঞ্চলেই গাজীপুরে গড়ে তুলা হয় তুলা গবেষণা কেন্দ্র। দেশের গরিষ্ঠভাগ চা বাগানসমূহ সিলেট বিভাগে, যা এখনো পর্যন্ত সাঁওতাল-মুন্ডা-কোল-ভূমিজ-ওরাঁও-খাড়িয়া-দেশোয়ালীসহ আদিবাসী শ্রমিকদের ঘাম ও যত্নে পরিচালিত। দিনাজপুর দেশের এক উল্লেখযোগ্য ধান-উৎপাদন এলাকা। দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, ঠাকুরগাও, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, নাটোর, পাবনা, গাইবান্ধা জেলার কৃষি-উৎপাদনে আদিবাসী নারী-পুরুষের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫০ সনে মধুপুরে জুম চাষ নিষিদ্ধ হওয়ার পর মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের মিজি মৃ নামের এক মান্দি নারীর উদ্যোগে নতুনভাবে শুরু হয় আনারস-আদা-হলুদ-পেঁপে-কচু-থাবুলচুর (শিমূল আলু) এক মিশ্র চাষ। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট অঞ্চলের আদিবাসী খাসিরা খাসি-পান, সুপারি, লেবু, গোলমরিচ উৎপাদনে বেশ পারদর্শী। খাসি জনগণকে দেশেকে ঐতিহাসিকভাবেই খাসি পান সরবরাহ করে আসছেন, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ রপ্তানিও হচ্ছে খাসি পান ও অন্যান্য কৃষিপণ্য। সিলেট অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই সাতকড়া, জারা, আদাজামির, কাটাজামির নামের বৈচিত্র্যময় লেবুর জন্য বিখ্যাত। ঐতিহাসিকভাবে এসব লেবু মূলতঃ চাষ করে আসছেন সিলেটের আদিবাসী লালেং বা পাত্র সমাজ। কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর রাখাইন আদিবাসীরা সামুদ্রিক শুঁটকী ও নাপ্পি নামের একধরণের প্রক্রিয়াজাত শুঁটকি উৎপাদন করেন। লবণ উৎপাদনেও জড়িত আছেন রাখাইন ও কিছু তঞ্চংগ্যা পরিবার। নাপ্পি ও সামুদ্রিক শুঁটকি জোগান দিয়ে চলেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ, যার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেশের বাইরে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যে রপ্তানীও হয়। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, শেরপুর-জামালপুর ও নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী অঞ্চল, উত্তরাঞ্চল, শ্রীমঙ্গলের ত্রিপুরাগ্রামসমূহ, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য এবং সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বসবাসকারী মান্দি, ত্রিপুরা, কোচ ও হাজং আদিবাসীরা এখনো বৈচিত্র্যমূ সুগন্ধি জুমধান আবাদ করেন। স্থানীয় প্রয়োজন মিটিয়ে যা দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে মজবুত করতে অসামান্য ভূমিকা রাখছে।
চার
এখন প্রশ্নটা হচ্ছে আদিবাসী জনগণের এই ঐতিহাসিক জীবনধারা এবং অর্থনৈতিক খাতকে আমরা কোন দার্শনিকতার প্রশ্নে হিসাব করবো? প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনই বা বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে? জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনা-উদ্যোগ প্রক্রিয়ায় ‘কম কার্বন ভিত্তিক অর্থনীতি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এখানে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয় যেখানে সবচে’ কম গ্রীন হাউজ গ্যাসের নির্গমন ঘটে। বিশেষজ্ঞরা সকল গ্রীন হাউজ গ্যাসের ভেতর কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর নির্গমনকেই বেশি চিহ্নিত করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে। কারণ যত বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গত হয় ততবেশি পৃথিবীর আবহাওয়া চক্র এবং জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবী মুহূর্তে মুহূর্তে উষ্ণ হয়ে উঠে। শিল্পকারখানা, ভোগবিলাসি জীবন, যানবাহন, ইলেকট্রনিক এবং ডিজিটাল পণ্যের ব্যবহার, রাসায়নিকের ব্যবহার এই কার্বন নির্গমন এবং উষ্ণায়নকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি অনেক কম কার্বন নির্গমন করে। পৃথিবীর প্রায় ৪৫ ভাগ ভূমি কৃষির আওতাধীন এবং এখান থেকে মাত্র ১৩.৫ শতাংশ গ্রীণ হাউজ গ্যাসের নির্গমন ঘটে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যারা কৃষিকাজ করে, মাছ ধরে, কুটিরশিল্প করে, বনজদ্রব্য আহরণ করে, কবিরাজী করে, পশুপালন করে, গান বাদ্য করে, শিকার করে, সংগ্রহ করে জীবন নির্বাহ করেন এরাই ঐতিহাসিকভাবে গড়ে তুলেছেন কম কার্বনভিত্তিক অর্থনীতির মজবুত পাটাতন। ধারণা করা হয় যে, বিশ্বের ৫টি উপমহাদেশের ৭০টিরও বেশী দেশে কমপক্ষে ৫০০০ আদিবাসী জাতির ৩০০ মিলিয়ন লোক বাস করে যাদের জীবন পদ্ধতি, ভাষা, জীবিকা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন। আর এই আদিবাসী জনগণ তাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে কেবলমাত্র কমকার্বনভিত্তিক অর্থনীতি নয় গড়ে তুলেছিলেন এক কার্বন-নিরপেক্ষ স্বর্নিভর অর্থনীতি। পাহাড় জংগলে খাদ্য-ঔষধি-জ্বালানি কুড়িয়ে, জুম আবাদ করে, মধু-মোম সংগ্রহ করে, পশু পালন করে, শিকার ধরে, স্থানীয় বনজ দ্রব্য আহরণ করার ভেতর দিয়েই এককালে গড়ে উঠেছিল আদিবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার। আজ যখন প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে হাজির হয়েছে বিশ্বনেতৃত্ব তখন আদিবাসী জনগণের এই জলবায়ুবান্ধব কার্বন নিরপেক্ষ বা কম কার্বনভিত্তিক ঐতিহাসিকতা অনুচ্চারিতই থাকছে। জলবায়ু দেনদরবার মূলত: আটকে আছে কর্পোরেট জ্বালানি কোম্পানির বাণিজ্যতর্কের ভেতর। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়া বাংলাদেশ এখনো জোর গলায় আদিবাসী জনগণের কার্বন নিরপেক্ষ জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু দরবারকে প্রশ্ন করেনি।
পাঁচ
বরং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে কী করছে? একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ঘোষণা দিয়ে অপরদিকে কর্পোরেট নানা এজেন্সিকে বৈধতা দিয়ে চলেছে রাষ্ট্র। আর দিনে দিনে কর্পোরেট বাণিজ্যের প্রশ্নহীন বিস্তৃতি, তথাকথিত মুক্তবাজারের প্রবেশ এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলা আদিবাসীদের কার্বন-নিরপেক্ষ জীবনধারাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। কার্বন-নিরপেক্ষ আদিবাসীদের জীবনকেও কর্পোরেট বাজারের পণ্যদাস বানাতে বাধ্য করেছে। স্থানীয় সম্পদ এবং নিজস্ব উৎপাদন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল যে বৈচিত্র্যময় আদিবাসী সামাজিক জীবন সেই স্বর্নির্ভরতা আজ কর্পোরেট বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের ফলে ভেঙ্গেচুরে গেছে। আদিবাসীদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত খাদ্য-পানীয়-পরিধান সংস্কৃতিকে কোনো বিবেচনা না করে কোকাকোলা-পেপসি-ম্যাকডোনালস-সিনজেন্টা-মনসান্টো-ফাইজার-এডিডাস-নাইকি কোম্পানির বাজার জোর করে গিয়ে ঢুকেছে আদিবাসী গ্রামে গ্রামে পাহাড়ে জংগলে। উন্নয়নের নামে আদিবাসী বসত দখল এবং আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে ইকোপার্ক-জাতীয় উদ্যান-অবকাশ কেন্দ্রর নামে কর্পোরেট কোম্পানিরা বানিজ্যিক পর্যটনকে চাঙ্গা করছে প্রশ্নহীনভাবে। আদিবাসী জীবনের কার্বন-নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এভাবেই দিনে দিনে গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে আবার জলবায়ু পরিবর্তিত দুনিয়ায় সাফাই গাওয়া হচ্ছে কার্বন-নিরপেক্ষ অর্থনীতির। কিন্তু এখানেই কার্বন-নিরপেক্ষ অর্থনীতির মৃত্যুদন্ড থামিয়ে রাখেনি বানিজ্যিক বিশ্বায়ন, গবেষণার নামে আদিবাসী এলাকায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে সমানে আদিবাসী এলাকার প্রাণসম্পদ এবং আদিবাসীদের লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লুটপাট করা হয়েছে। আদিবাসী এলাকায় প্রাণডাকাতি এবং জ্ঞানডাকাতি সমানে এখনও প্রশ্নহীন কায়দায় অব্যাহত আছে। অথচ আদিবাসী এলাকার স্থানীয় প্রাণসম্পদ এবং আদিবাসীদের নিজস্ব জ্ঞানপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই গড়ে উঠেছে আদিবাসীদের নিজস্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা। যে প্রক্রিয়া কম কার্বনভিত্তিক এবং কার্বন-নিরপেক্ষ জীবনের কথা বলে। যা জলবায়ু সংকটে বিপদাপন্ন দুনিয়ার প্রাণ ও প্রকৃতির ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখবার জন্য একমাত্র অবলম্বন। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের অর্থনৈতিক উৎপাদনধারা মূলত: কার্বন-নিরপেক্ষ দার্শনিকতাকেই প্রমাণ করে চলেছে।
পাঁচ
বিশ্বব্যাপি আদিবাসীদের সাথে অরণ্যের এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রাকৃতিক বনভূমিগুলোকে আজ জলবায়ু দেনদবারের ময়দানে নতুন নামে ডাকা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ‘কার্বণ শোষণাগার’। আর এ নিয়ে তৈরি হচ্ছে অরণ্যনির্ভর আদিবাসী, রাষ্ট্র ও এজেন্সির ভেতর নয়া সংঘাত। জার্মানির ‘ফরেস্ট স্টিওয়ার্ডশিপ কাউন্সিল’ নামের প্রতিষ্ঠানটি মনে করে বনভূমি সবার জন্য সকল সময়ের জন্য। এই সংগঠনের এনাকারিনা পেরেজ ওরোপেজাও এসেছেন প্যারিস সম্মেলনে। জানালেন, প্রাকৃতিক বনগুলো সুরক্ষায় আমাদের আরো ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। স্থানীয় মানুষদের পেশা এবং সংষ্কৃতিকে মর্যাদা দিতে হবে। সম্মেলনে যোগ দেয়া বাংলাদেশের বনসংরক্ষক মো. মযহারুল ইসলামও বনভূমি সুরক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার কথা জানান। কিন্তু বাংলাদেশসহ দুনিয়াব্যাপি অরণ্য গুলো কী আর অরণ্যনির্ভর আদিবাসী জনগণের কাছাকাছি থাকতে পারছে। বহুজাতিক খনন, বিদ্যুৎপ্রকল্প, ইকোপার্ক, কর্পোরেট পর্যটন নানাভাবে অরণ্য ও আদিবাসী জীবনের সখ্যতা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি সুন্দরবন থেকে সকল ধরণের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করে এই বনের উপর নির্ভরশীল বনজীবীদের প্রথাগত অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিজেনাস পিপলস ফোরাম অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ প্যারিস সম্মেলনের উদ্বোধনীর দিনেই জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা বরাবর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক চুক্তির ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগণর দাবিসমূহ তুলে ধরেছে। ১১টি দাবির ভেতর দিয়ে তারা প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আদিবাসী জনগণের অধিকার সুরক্ষার প্রশ্নকে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। সম্মেলনে অংশ নেয়া বাংলাদেশের আদিবাসী সংগঠক ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা জানান, আদিবাসীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ গুলো মোকাবেলা করছে। কিন্তু সামনে আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। জলবায়ু নিয়ে ধনী রাষ্ট্রের ছলচাতুরি ও জুয়া খেলা বন্ধ করতে হবে। আদিবাসীদের দাবিগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। আশা করি জলবায়ু নিয়ে ধনী দেশ এবং কর্পোরেট এজেন্সির লাগাতার জুয়া খেলা বন্ধ হবে। আদিবাসীসহ বিশ্বের সকল প্রাণের সংহতির ভেতর দিয়েই তৈরি হবে এক কাংখিত জলবায়ু ঘোষণা।
………………………………………………………………………………………………………………….
গবেষক ও লেখক। ইমেইল : [email protected]