প্রকৃতি সংরক্ষণের এখনই সময়
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2020/06/102679837_1107077966346102_4994223324927546850_n-1.jpg)
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান:
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রতিবছরেই দিবসটির উপলক্ষে সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠনগুলো নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। বারসিকও পরিবেশ দিবস উপলক্ষে মানিকগঞ্জ কর্ম এলাকায় মাসব্যাপি বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পৃথিবীব্যাপি আজ এমন এক সময়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে যখন সারা দুনিয়া করোনা নামক অদৃশ্য এক ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছে নিজেদের টিকে থাকার জন্য।
প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে বারবার দুর্যোগের মুখে পতিত পড়েছে দেশ। সিডর, আইলা, মহাসেন, সুনামি, নার্গিস, বুলবুল, ফণী, আম্পান,সর্বশেষ নিসর্গের আক্রমণ থেকে রক্ষা করছে উপকূলের সুন্দরবন। প্রকৃতি, পরিবেশ ও কোটি প্রাণের আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্কের মধ্য দিয়েই টিকে আছে মানুষ। প্রকৃতি ও পরিবেশের মাঝেই মানুষের অস্তিত্ব। প্রকৃতি, পরিবেশ ও সকল প্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমেই মানুষকে তার বেচেঁ থাকার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানুষ যতই আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে, পরিবেশের উপরে ততই চাপ পড়ছে। ফলে বাড়ছে কল কারখানার কালো বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্য। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য, বাসস্থান এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে বনাঞ্চল, নদী-নালা, খাল-বিল। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে এসব স্থানে বসবাস করা বিভিন্ন ধরণের ছোট বড় বন্যপ্রাণী।
উন্নয়নের নামে প্রাণ প্রকৃতির অস্তিত্ব স্বীকার না করে নিয়ম বর্হিভূতভাবে কৃষি জমিতে ইটের ভাটায় বৃক্ষ পোরানোসহ নানাভাবে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছ। আজকের দিনে পরিবেশ দূষণ বিশ্বজগতের জন্য একটি বিরাট হুমকি। পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষের অস্তিত্ব আজ চরম সংকটে। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য প্রতিদিন বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। দেশে বজ্রপাত, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ধস, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক না থাকলে উষ্ণ হবে পৃথিবী, মরুভূমি হবে দেশ এবং মানুষের অস্তিত্ত্ব হবে বিপন্ন। তাই পরিবেশ দূষণরোধে ব্যক্তিগতভাবে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি সমষ্টিগতভাবে বৃক্ষ নিধনের প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলার পাশাপাশি আগামী দিনের জন্য একটি সুস্থ ও বসবাস উপযোগী দুষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
পৃথিবী সৃষ্টির আদিলগ্নে মানুষ ছিল একান্তভাবে পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। মানুষ ও পরিবেশ তখন একই সূত্রে গাঁথা ছিল। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে যে পারষ্পারিক আন্তঃনির্ভশীল ছিল তা ধীরে ধীরে সে সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। যেদিন মানুষ নিজেদের রুচি অনুসারে পরিবেশ গড়ে তুলতে চায় সেদিন থেকেই দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। জীবনের তাগিদে, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষ পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করেছে। কিন্তু একটি দেশের আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা জরুরি। বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় আঠারো শতাংশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বনভূমি, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চলে বনাঞ্চল রয়েছে। তাছাড়া সুন্দরবন বাদ দিলে বন বলতে যা অবশিষ্ট থাকে তা খুবই সীমিত।
বন সীমিত হলেও বৃক্ষ নিধনের প্রতিযোগিতা থেমে থাকেনি। গাছের সঙ্গে আমাদের অন্যায় আচরণ আজ আমাদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। যেন আমরাই হেসে খেলে নিজেদের মরণফাঁদ তৈরি করছি। গাছের অভাবে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। যে সকল ফসল ছায়ায় উৎপন্ন হয়, সেসবের উৎপাদন বহুলাংশে কমে যাবে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অভাবে অধিকাংশ ফসলের উৎপাদন কমে যাবে। যে সকল ফসল বর্তমানে চাষ করতে সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো তখন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মাটি অতিরিক্ত শুষ্ক হওয়ার কারণে ফসল চাষের জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু একসময় সেসবও অকার্যকর হয়ে পড়বে। তখন পৃথিবীর অধিকাংশ ভূমি চাষ ও বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা সহসাই ভুলে যাই বনভূমি বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফসল ভালো হয়। তা ছাড়া গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, ভূমির ক্ষয়রোধ করে। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে।
আবার গাছ শুধু প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যই রক্ষা করে না। গাছ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে রাখে গুরত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে আমরা গাছের জীবনই ধ্বংস করিনি, তার সাথে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জীবনও ধ্বংসের চূড়ান্ত আয়োজন করেছি। ফলে অনেক প্রাণীর এখন আর দেখাই মিলছে না। হারিয়ে যাচ্ছে জীব বৈচিত্র্য। তাছাড়া বাঙালির লোকায়ত সংষ্কৃতির অবিচ্ছেদ্ধ অংশ গাছ। আমাদের গ্রামীণ সমাজে হাট-বাজারের নিত্য নৈমিত্তিক দৃশ্য ছিল বিশাল কোনো গাছের নিচে হাটবাজার। যাকে সচরাচর আমরা হাটতলা-বটতলা নামে চিহ্নিত করতাম। বটগাছকে ঘিরে হাট-বাজার ছিল প্রায় গ্রামেরই সাধারণ দৃশ্য। বটতলাকে কেন্দ্র করে আয়োজন হতো গ্রামীণ মেলা। গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিত না এমন পথিক খুব কমই ছিল। কিন্তু হাটতলার সঙ্গে বটতলার দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কে যেন আজ চিড় ধরেছে। নির্বিচারে নিজের প্রয়োজনে গাছ কেটেছি কিন্তু চারা রোপণ করার প্রয়োজন অনুভব করিনি। শুধু মানুষ নয় তার সাথে গাছ ও প্রাণীকূলের যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে গাছ লাগানোর পাশাপাশি গাছের সঠিক পরিচর্যার ব্যাপারে সব মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। বিলুপ্তপ্রায় গাছকে সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বৃক্ষ রোপণের গুরত্ব দিতে হবে। অবৈধভাবে গাছ কাটা বন্ধের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। তা না হলে প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয়ে মানব সভ্যতাও বিপর্যয়ে মধ্যে পড়বে। মানবের সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতি সংরক্ষণের এখনই সময়।