লোকায়ত চর্চা ও গ্রামীণ নারী
নেত্রকোনা থেকে পার্বতী সিংহ
পরিবেশ রক্ষায়, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় স্থায়িত্বশীল জীবনযাপনে ও পরিবেশীয় উপাদানের ধারক ও বিকাশে গ্রামীণ নারীর চর্চা ও জ্ঞান একটি অপরিহার্য ভূমিকা রেখে চলছে। মানুষ প্রকৃতি থেকে যত দূরে যাচ্ছে ততই জীবন যাপনের স্থায়িত্বশীলতা হারাচ্ছে। নিজস্ব চর্চাকে ভুলে গিয়ে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মানুষ নানান আধুনিক জীবনব্যবস্থায় জড়িয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে তারা যান্ত্রিক নির্ভর হয়ে পড়েছেন দিনকে দিন। লোকায়ত চর্চাকে নির্বাসনে ফেলে আধুনিক ও যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে বর্তমানে মানুষ যেমন নানান ধরনের রোগ, ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে তেমনিভাবে তাদেও মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে সামাজিকতা, মানবিকতা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারা।
যুগে যুগে, কালে কালে গ্রামীণ নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে খাদ্য যোগান, বাসস্থান তৈরি, রোগে চিকিৎসা, তৈষজপত্র তৈরি, সংস্কৃতি চর্চা, শস্য ফলিয়ে আসছেন। গ্রামের নারীরা জানেন কোন রোগের চিকিৎসায় কি ধরনের গাছ-গাছড়া ব্যবহার করতে হবে, কোন গাছ কেমন করে লাগাতে হবে, কোন সময় কিভাবে সবজি তুলতে হবে, কিভাবে বীজ রাখতে হবে, কখন রোদে দিতে হবে, হাসঁ-মুরগির রোগ কিভাবে কম হবে আরো কত কি? আমাদের গ্রামীণ নারীরাই তাদের চারপাশের প্রাকৃতিক সম্পদের লোকায়ত জ্ঞান ব্যবহারের ভেতর দিযে গড়ে তুলেছেন এক স্থায়িত্বশীল আনন্দময় জীবন।
খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য সংরক্ষণ, খাদ্য প্রস্তুতকরণ সবকিছুই নারীরা করে আসছেন। মোট কথা খাদ্যের সাথে তাদের যোগসূত্র ছিলো স্মরণাতীতকাল থেকেই। আজও এ ধারা টিকে আছে আমাদের গ্রামীণ সমাজে। নারীরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকেই বছর পর বছর সেটি লালন ও পালন করে আসছেন। তাই তো নারীর সাথে প্রকৃতির, সমাজের, সংস্কৃতির, পরিবারের সর্ম্পকগুলো আরো নিবিড় হয়েছে।
এরকমই একজন নারী ফাতেমা (৬০)। নিজের আশপাশে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করেই জীবনযাপন করে আসছেন তিনি। নেত্রকোনা জেলার চল্লিশা ইউনিয়নের পচাশিঁপাড়া গ্রামে বসবাস করেন। ১৬ বছর বয়সে বউ হয়ে আসেন এই গ্রামে। স্বামী মারা গেছেন কয়েক বছর হল। সেই সাথে একটি ছেলে সন্তানকেও হারিয়েছেন অকালে। বর্তমানে দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। কিন্তু ছেলেদের বিয়ে হওয়ার পর তিনি আলাদা থাকেন। তাঁর এক ছেলে গ্রামে থাকেন এবং আরেক ছেলে ঢাকা গার্মেন্সে চাকরি করেন বলে সেখানে থাকেন। তিনি বাড়িতে একা থাকলেও কখনও সেটা মনে করেন না। কারণ তাঁর সাথে রয়েছে হাঁস-মুরগি, বসতভিটার শাকসবজি ও প্রকৃতি। মূলত তিনি শাকসবজি উৎপাদন ও হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমেই ব্যস্ত সময় কাটান।
হাসঁ-মুরগির বাচ্চা তুলতে অনেকে ডিম নষ্ট করে ফেলেন। কিন্তু তিনি লোকায়ত পদ্ধতি যেমন মাটির পাতিলে ছাই, এগ্রাপাতা, বাশেঁর পাতা, পাটের বস্তা ব্যবহার করে এই কাজটি করেন। মাটির পাতিলে প্রথমে ছাই ও বিষকাঠালী পাতা দিয়ে একটি স্তর করেন। এরপর ছাই ও বাশঁপাতা দিয়ে আরেকটি স্তর করেন। তারপর পাটের বস্তা দিয়ে ডিম বসিয়ে দেন। এভাবেই তিনি প্রাকৃতিক সম্পদ সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই তিনি মুরগি বা হাঁসের ডিম নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এভাবে ডিম ফোটালে একটা ডিম নষ্ট হবে না। আবার কোন ধরনের পোকাও ধরবে না। প্রতিবছর আমি এই পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটাই এবং বিক্রি করি। সারাবছরে আমি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার হাসঁ-মুরগি ডিম বিক্রি করতে পারি।’ তাছাড়া হাসঁ-মুরগির রোগ প্রতিরোধে তিনি খাবারের সাথে ছুঁতি (নিজেদের খাবার পর এটো জল) পানি মিশিয়ে খাওয়ান বলে জানান।
ভালো কৃষাণী হিসাবেও তিনি গ্রামে বেশ পরিচিত। সবজি বীজ অঙ্কুরোদগমনেও লোকায়ত র্চচা করেন। মৌসুম অনুযায়ী ছোট ছোট বীজ যেমন মরিচ, ডাটা, সীম, লাউ জাতের বীজগুলো একদিন রোদে তাপ দিয়ে ভিজিয়ে রাখেন পাত্রে প্রায় ২৪ ঘণ্টা । তারপর বীজ থেকে পানি ঝড়িয়ে সুতি কাপড়ে বীজগুলো রেখে ঠান্ডা জায়গায় রেখে দেন। কখনো কাপড়টি শুকিয়ে গেলে কাপড়ে হালকা পানি ছিটা দেন। এরপর বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়ে গেলে তিনি তা রোপণ করেন। এতে করে নষ্ট বীজগুলোকে আলাদা করা যায়। আর এই পদ্ধতিতে বীজ নষ্ট হয় না। বেশির ভাগ বীজই অঙ্কুরিত হয়।
সারাবছর সবজি হিসাবে স্বর্ণ আলু সংরক্ষণ করেন এবং বিক্রিও করেন। তিনি মাটির নীচের মূল আলুগুলো মাটির পাত্রে অথবা মাটিতে ভালোভাবে শুকিয়ে পাটের চট দিয়ে ঢেকে রেখে সংরক্ষণ করেন। এরপর ফাল্গুন মাসে বীজ থেকে কেড়ু–ল আসার পর মাটি অল্প গর্ত করে গাছ আছে এমন জায়গায় লাগিয়ে দেন। এতে করে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে ফল ধরা শুরু করে।
তিনি ধান বীজ অঙ্কুরোদগমে ধানের কলস ও ধান প্রথমে রোদে পর পর ৪দিন তাপ দিয়ে পাটের বস্তায় পুকুর কিংবা মাটির পাতিলে ভিজিয়ে রাখেন প্রায় ২৪ ঘন্টা। এরপর মাটির পাত্রে বা অন্য কোন পাত্রের নীচে বিষকাঠালী পাতা, নিমপাতা বিছিয়ে স্তরে স্তরে ধান রাখার পর উপরের স্তরে পাতাগুলো দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর মাটির কলসের মুখে মুচি দিয়ে মাটি দিয়ে ভালোভাবে লেপে দেন। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর কেড়ু–ল আসলে বপনের জন্য প্রস্তুত করেন। আম, কাঠাঁলের বীজ অঙ্কুরোদগমে মাটির উপরে রেখে কাঁঠাল বীজ আর অল্প গর্ত করে আমের চারা রোপণ করেন।
প্রকৃতির সাথে নারীর এই সম্পর্ক এত নিবিড় যে, এর কোন একটাতে আঘাত করলে বা ভেঙ্গে গেলে যার প্রভাব শুধুমাত্র নারীর ওপরই নয় বরং নারীর সাথে সর্ম্পকিত প্রতিটি স্তরেও এর প্রভাব পড়বে। তারপরও আমাদের গ্রামীণ নারীরা নিজের নিত্য দিনের প্রয়োজন মেটায় প্রকৃতি থেকে। প্রতিনিয়ত নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে নিজের জ্ঞান র্চচায়, অভিজ্ঞতায় প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন। উন্নয়নে সর্বপ্রথম নিশ্চিত করতে হবে গ্রামীণ নারীর চারপাশের প্রাকৃতির সম্পদের উপর তার স্বার্বভৌম অধিকার।