কম্বোডিয়ার মধু দুনিয়া সম্মেলনের অভিজ্ঞতা
শাহীন ইসলাম, আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, বারসিক
“নো বিজ নো ট্রিস” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২৬ এপ্রিল ২০১৫ কম্বোডিয়াতে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় মধু দুনিয়া সম্মেলনের উদ্বোধনী। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শাহিন ইসলাম সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা একটি নতুন সম্পর্কজাল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ জীবন ও তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে এবং আমরা আমদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পেরেছি। বন, পাহাড় নির্ভর লোকায়ত পেশাজীবী জনগোষ্ঠী, সাংবাদিক, উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি, যুবক, নারী, বাংলাদেশ, ভারত, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেন। সম্মেলনের প্রথম দিনে মৌমাছি, মধু, বন, পাহাড়, পরাগায়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, জীবনজীবিকা, ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধে মধু থেকে গবেষণা সফলতা, মৌমাছি প্রতিবেশ, স্থায়িত্বশীল প্রক্রিয়া, বিশ্ব বাজার পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকটি ভিজুয়াল ডকুমেন্টোরি উপস্থাপনা, মৌমাছি, মধু ও জীবনের ডকুমেন্টেশারি ফ্লিম ইত্যাদি দেখানো হয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মৌমাছি, মধু ও নির্ভরশীল জীবনযাত্রার নানান দিক নিয়ে ক্রিসি মারিয়া একটি টকশো সঞ্চালনা করেন।
বৈচিত্র্যময় মধু ও কাঠ বর্হিভূত বনজ সম্পদ ও নিপুণ কারুময় হস্তশিল্প পণ্য প্রদর্শনী সম্মেলনের পরিবেশকে জাকজমকপূর্ণ করে রাখে। সম্মেলনে ৬টি দেশের প্রতিনিধিরা এনটিএফপির সাথে মৌমাছি ও মধু জীবনের পাশে থাকার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এরপরই দিনের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পালা শুরু হয়। অন্যান্য দেশের মতই বারসিককে আলোচনার জন্য আহবান জানানো হয়। আলোচনায় পৃথিবীর বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনের এপিক ডরসটা মৌমাছি ও সুন্দরবনের মৌয়ালী (মধু সংগ্রহকারী) জীবনের গল্প, সুন্দরবন ও মধুজীবনের সহায়ক বারসিক কাজের অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বর্নণাসহ প্রথম দিনের চমৎকার, উদ্ভাবনী ও শিক্ষনীয় কর্মসূচিগুলো উপস্থাপন করা হয় । সুন্দরবনের মধু বিষয়ে এই উপস্থাপন সকলকে আকৃষ্ট করে। আলোচনায় বলা হয়, এক ধরণের দানবাকৃতির জায়ান্ট মৌমাছি স্বভাবে বন্য ও হিংস্র সুন্দরবনে বেশী দেখা যায়। এরাই সুন্দরবনে সিংহভাগ মধু উৎপাদন করে থাকে। সাধারণত সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছে যখন ফুল ফোটে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল মাসে। তখন এ প্রজাতির মৌমাছিরা সুন্দরবনে আসে ও বিভিন্ন গাছে মৌচাক তৈরি করে এবং ফুলের নেক্টার সংগ্রহ করা মাধ্যমে মধু উৎপাদন করে থাকে। বন বিভাগের নিকট হতে প্রতি বছর ১ এপ্রিল/১৮ চৈত্র পারমিট সংগ্রহ করে মৌয়ালীরা সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করে থাকেন। যে সকল বনজীবি সুন্দরবনের মধু ও মোম সংগ্রহ করে জীবিকা অর্জন করে থাকেন তাদের মৌয়ালী বলা হয়। সুন্দরবনের মোট উৎপাদিত মধুর সিংহভাগ আহরিত হয় সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনাঞ্চল থেকে। এ অঞ্চলে মধু উৎপাদনকারী বৃক্ষ যেমন- খলসী, গরাণ, বাইন, কেওড়া, গেওয়া ইত্যাদির আধিক্য থাকায় তুলনামূলকভাবে বেশী পরিমাণ মধু আহরিত হয়। সুন্দরবনের মধু কেন্দ্রিক জীবন-জীবিকাটি বেশ প্রাচীন। মৌয়ালীরা যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশার সাথে সম্পৃক্ত। মৌয়ালীগণ সুন্দরবন থেকে ১৯৬০ সাল হতে মধু সংগ্রহ করে আসছেন। সুন্দরবনের মধুসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল সংরক্ষণ ও ব্যবহারে বনজীবী মৌয়ালীদের লোকায়ত জ্ঞানের স্বীকৃতি খুবই গরুত্বপূর্ন। সুন্দরবনই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। সেজন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বনের কোন সম্পদের তারা ক্ষতি করে না। কিন্তু আজও তারা সমাজের নিপীড়িত, নির্যতিত ও শোষিত শ্রেণীর মানুষ। যে কোন সময়ে তারা বাঘ ও বিষধর সাপের আক্রমনে জীবন হারাতে পারে। মহাজন, ও অন্যান্য পেশার মানুষের ঘুষ/চাঁদা এবং নানান অত্যাচারে তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন। সুন্দরবনের মধু প্রতিবেশের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা, মৌয়ালীদের জীবন-জীবিকার মান উন্নয়ন এবং পৃথিবীর ভৌগলিক নির্দেশক পন্য সুন্দরবন মধুর বাজার তৈরীতে ধারাবাহিক সহায়তা প্রয়োজন। আর এজন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়।
কম্বোডিয়ার মুনডোলকিরি পাহাড়ে সম্মেলনের দিনগুলো ছিল নান্দনিক ও সৃজনশীল। সেখানে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্ডিয়া ও কম্বোডিয়া তাদের নিজ নিজ দেশের কার্যত্রম তুলে ধরে। সম্মেলনে মধুর বাজার, ট্রেডমার্ক, প্রোটকল বিষয়ক দলীয় আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। একদিন পাহাড়ে যেয়ে সেখানকার পুনং জনগোষ্ঠীর মধু সংগ্রহ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করি। সম্মেলনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধু ও অন্যান্য বনজ সম্পদ থেকে তৈরী পণ্য বিক্রির উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে ধারাবাহিক রাখতে প্রতিটি দেশ একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরী করে। সম্মেলনের শেষের দিয়ে কম্বোডিয়ার আদিবাসীদের ধানকেন্দ্রিক গান ও দলীয় নৃত্য সকলকে মুগ্ধ করে। স্মরনীয় ছিল মৌমাছি, বন ও মধুজীবনের অকৃত্রিম বন্ধু ইন্ডিয়ার কিষ্টন ফাউন্ডেশনের লিওকে মধু দুনিয়া এওয়ার্ড ২০১৫ প্রদান। লিও তোমাকে অভিনন্দন।