বৈরী আবহাওয়ার কবলে বরেন্দ্র অঞ্চল: কার্যকর দুর্যোগকালীন শস্যবীমা চালুর দাবি
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
জলবায়ু পরিবর্তনের আঞ্চলিক অভিঘাত বরেন্দ্র অঞ্চলে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণেই খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে দিনে দিনে বৈরি রূপ নিচ্ছে আবহাওয়া। ফলে এই অঞ্চলটিতে অধিক খরা এবং অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি আমন মৌসুমে কৃষক বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়া এবং এর সাথে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবার কারণে আমনের ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এবার আমনের বাম্পার ফলনের আশা করছিলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা। ক্ষেতভরা সবুজের হাসি। বিল ভরা আমনের ক্ষেত। কোন কোন ধান বের হয়েছে আধাপাকা আবার কোন ধান কেবল গর্ভাবস্থায় (থোড়) বের হবে বলে। এরই মধ্যে বেশ কিছুদিন থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হচ্ছিলো না। এমনিতেই বরেন্দ্র অঞ্চল একটি খরাপ্রবণ এলাকা। তাই ধান বের হবার সময়ে একটু বৃষ্টি প্রত্যাশা করছিলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকগণ। কিন্তু অতিবৃষ্টির সাথে প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া-বাতাস বয়ে যাবার কারণে ধান ক্ষেতের ধানগুলো মাটিতে হেলে পড়েছে. যার ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলন আসবেনা বলে আশঙ্কা করছেন কৃষক।
বিগত কয়েকদিনের অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং ফসলের ক্ষতির নানা দিকগুলো প্রতক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং কৃষকের মতামত ও তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছেন বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে-সুলতানা খাতুন, রিনা টুডু, আয়েশা খাতুন, রায়হান কবির রঞ্জু, ব্রজেন্দ্র নাথ, অমৃত কুমার সরকারসহ লেখক নিজেও। তথ্যগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে দিনে দিনে আরো বৈরি রূপ নিচ্ছে স্থানীয় আবহাওয়া। যার ফলে হরহামেশাই বা হঠাৎ করেই নানা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষকরা।
একদিকে খরা অন্যদিকে বৈরি আবহাওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় হরহামেশাই। কৃষকদের মতে, ইদানিং যখন বৃষ্টিপাত হয়, দেখা যায় অতিবৃষ্টি হচ্ছে। আবার খরার সময়ে খরা বেশি দেখা দিচ্ছে। কৃষকগণ মনে করেন আগের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহওয়া-জলবায়ু আরো বেশি অচেনা হয়ে গেছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ধানসহ বিভিন্ন শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।
পবা উপজেলার ভিলনেপাল পাড়ার কৃষক মোস্তফা এবার ১০ বিঘা জমিতে উফশি জাতের বিভিন্নজত স্বর্ণ, দেশি ধান চেঙ্গুইল এবং আতব জাতের ধান লাগিয়েছেন। এর মধ্যে ৭০ ভাগ ধানই জমিতে হেলে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘জমিতে পানি থাকায় ধান হেলে পড়াতে ধান চিটা হবে অন্যদিকে খড়ও নষ্ট হবে। ফলে একদিকে যেমন ফলন কম আসবে অন্যদিকে গরুর খাওয়ানো খড় কম আসবে।’ তাঁর মতে, বিঘা প্রতি ৪ থেকে ৫ মণ ধান কম আসবে। অন্যদিকে খড় নষ্ট হওয়ায় গবাদি পশু ও জ¦ালানির সমস্যা দেখা দিবে। তানোর উপজেলার বাধাইড়, দুবইল, মোহর, তালন্দ, মন্ডুমালা এবং বিলকুমারি বিলের এলাকার অবস্থাও একই রকম।
অন্যদিকে খরাপ্রবণ উ”ু এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় আমন মৌসুমে উফশি জাতের পাশাপাশি কৃষক বিভিন্ন দেশি ধানের জাতের চাষও করেছিলেন। ধানগাছগুলো থোড় অবস্থায় পানিতে পড়ে যাবার কারণে ফলন কম আসবে বলে জানা যায় কৃষকদের কাছ থেকে। কৃষকদের ভাষ্যমতে, ‘যে সকল ধানের গাছ ছোট সেসব ধানের গাছ হেলে পড়েনি। একই সাথে দেশি জাতের ধানগাছ যেমন চেঙ্গুইল, আতব (স্থানীয় মওক্কা) কিছু জাত সম্পূর্নরূপে হেলে পড়েনি।
তানোর দুবইল গ্রামের জাতীয় পরিবেশপদক প্রাপ্ত কৃষক ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে আগের তুলনায় দুর্যোগ বেড়ে গেছে, প্রান্তিক কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে, ফসল চাষাবাদে খরচ বেশি।’ তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আলাদাভাবে দুর্যোগকালিন শস্যবীমার দাবি করেন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত খরাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্র অঞ্চলটি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এখানে দুর্যোগের মাত্রা এবং পানি কেন্দ্রিক সমস্যাগুলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আলাদা। একদিকে যেমন খরার কারণে ফসল উৎপাদনে সমস্যা আবার খরচ বেশি পড়ে অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের আঞ্চলিক অভিঘাতের কারণে এখানে আবহাওয়া আরো বৈরি আকার ধারণ করছে। হঠাৎ বৃষ্টি এবং অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এর মধ্যেও কৃষক তার নিজস্ব জ্ঞান দক্ষতা এবং এলাকা উপযোগী জাত নির্বাচনসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে। দেশের অর্থনীতিসহ খাদ্য উৎপাদনে অবদান রাখছেন। কিন্তু উৎপাদনমূল্যের তুলনায় পণ্যের মূল্য পান না কৃষক। আবার দুর্যোগের ক্ষতিসহ সার্বিক ক্ষতিগুলো প্রান্তিক কৃষককে আরো নিঃস্ব করে তুলছে। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য কার্যকর দুর্যোগকালিন শস্যবীমা চালু করা দরকার।