কমিউনিটির অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
কমিউনিটির মানুষদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে পরিবেশের ব্যাপক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় আর কমিউনিটি ভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই বলে বারসিক আয়োজিত ইউএস এইড এবং এফসিডিও এর অর্থায়নে এবং কাউন্টার পার্ট ইন্টারন্যাশনাল এর কারিগরি সহযোগিতায় ‘ঢাকা কলিং’ কনসোর্টিয়াম প্রকল্পের উদ্যোগে আজ ২৯ জুলাই জুম অনলাইন আলোচনা সভায় আলোচকরা অভিমত ব্যক্ত করেন। বস্তিবাসীনেত্রী হোসনে আরা বেগম রাফেজার সভাপতিত্বে ও বারসিকের প্রজেক্ট ম্যানেজার ফেরদৌস আহমেদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান। প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মো: খালেকুজ্জামন, লক হ্যাভেন বিশ^বিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: লেলিন চৌধুরী, ডেইলি আবজারভার এর সিনিয়র সাংবাদিক বনানী মল্লিক। অনুষ্ঠানের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা কলিং এর কনসর্টিয়াম কোঅর্ডিনেটর সানজিদা জাহান আশরাফি।
ধারণাপত্রে প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার মানের সাথে পাল্লা দিয়ে বর্জ্যরে পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এই বর্জ্য পরিবেশসম্মতভাবে অপসারণের অভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য। ঢাকা দক্ষিণ ও ঊত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষ বসবাস করে। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠির জীবনযাত্রায় সৃষ্ট বর্জ্যরে পরিমাণ অন্তত ১০ হাজার মেট্রিক টন। এর মাত্র ৬ হাজার টন দুই সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করে মাতুয়াইল এবং আমিনবাজারে ডাম্পিং করে। বাকি বর্জ্য নালা-নর্দমা, খাল হয়ে নদী যাচ্ছে এবং নি¤œাঞ্চল ভরাট করা হচ্ছে। দূষিত করছে নদীর পানি, ভরাট করছে নদীর তলদেশ। বৃহত্তর ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে প্রায় ৫০ লক্ষ নি¤œ আয়ের মানুষ বস্তি, রেল ষ্টেশন, টার্মিনাল, ফুটপাতে বসবাস করে। এই বিপুল জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বর্জ্য ব্যবস্থ্পনার মাধ্যমে পরিবেশসম্মত বাসযোগ্য ঢাকা মহানগরী গড়ে তোলা সম্ভব।’ তিনি আরও বলেন, ‘কঠিন বর্জ্যরে অনিরাপদ অপসারণ পরিবেশকে দূষিত করে এবং জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে। বাংলাদেশের নগরের বর্জ্যের শতকরা ৬৮-৮১ ভাগ হচ্ছে খাদ্য বর্জ্য। এটাকে সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে সম্পদে পরিণত করা যাবে।
অধ্যাপক মো: খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট আইন মানা হয় না। বাংলাদেশে আইনের ঘাটতি নেই কিন্তু আইনের প্রয়োগও নেই। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিধিমালা নেই আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল কলেজে পরিবেশ ক্লাব ও তাদের দিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রায়োগিক কিছু ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নিয়ে প্র্যাকটিস করিয়ে তা সুপারিশ আকারে জাতির সামনে তুলে ধরা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরের ৬০ ভাগ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় আর বাকি ৪০ ভাগ যায় নদী-নালা ও খাল-বিলে আর এ থেকে তৈরি হয় মারাত্মক দূষণ। সরকারকে পরিবেশ বান্ধব করার জন্য জনগোষ্ঠীকে ভূমিকা নিতে হবে এবং কমিউনিটি বেজড বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মডেল গড়ে তুলতে হবে।’
ডা: লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আগে ছিলো ৭০ শতাংশ সংক্রামক ব্যাধী আর এখন হয়েছে ৭০ শতাংশ অসংক্রামক ব্যাধি। ঢাকা শহরের অধিকাংশ বস্তিবাসীরা এই সকল অসংক্রামক ব্যাধি ডায়েবেটিকস, প্রেসার, হার্টের সমস্যা, ক্যান্সারসহ নানান রোগে আক্রান্ত। আর এই সকল রোগের প্রধান কারণ হলো পরিবেশ দূষণ, তথা সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা।’ তিনি আরও বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপার অংশ তা নীতি নির্ধারক মহলকে মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক বনানী মল্লিক বলেন, ‘সাংবাদিক হিসেবে আমরা পরিবেশের নানাবিধ দিকগুলো তুলে ধরতে পারি। সরকারের আইন বিধিগুলো কেন কার্যকর না, প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়েও মিডিয়াতে এডভোকেসীর কাজ করতে পারি। কমিউনিটির সহযোগিতা কিভাবে বর্র্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকার গ্রহণ করতে পারে সেগুলো তুলে ধরতে পারি। সরকারের বিভিন্ন মহলকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে পারি মিডিয়াতে আলোচনা ও লেখালেখির মাধ্যমে।’
কাউন্টার পার্ট ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে ইফফাত জেরিন বলেন, ‘আজকের আলোচনায় যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো উঠে এসেছে সেগুলো নিয়েই আমরা ২ বছর কমিউনিটি ও সিভিল সোসাইটি নিয়ে কাজ করবো। আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচকদের নিকনির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরবো।’
আলোচনায় কমিউনিটিকে যুক্ত করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অংশীদারিত্বমূলক উদ্যোগ গ্রহণ, বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার জন্য কমিউনিটির শক্তিকে কাজে লাগানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখে নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে জায়গাগুলোতে নীতিমালা নেই সেখানে এডভোকেসী করা, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের নানান অসংগতিগুলোকে মিডিয়া এডভোকেসীর মাধ্যমে তুলে ধরা, সকল আইন ও নীতির অসংগতি নিয়ে নিয়মিত সরকারের কাছে দাবি তুলে ধরাসহ নানান সুপারিশ করা হয়।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বস্তিবাসীনেতা মো: হান্নান আকন্দ, নেত্রী সালমা আক্তার হাজারীবাগের ইয়ুথ লিডার বৈশাখী, হোসনে আরা বেগম রাফেজা, কাপের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবাকা সান ইয়াত, ঢাকা কলিং এর টেকনিক্যাল এ্যাডভাইজার সুমন আহসান, বারসিকের নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন, কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সুলতান এস চাঁদ, বস্তিবাসী নেতা হারুন আর রশিদ, ফাতেমা আক্তার, সোহেল রানা, সাবিনা ইয়াসমিন, ইয়ুথ লিডার সামিয়া আজম প্রমূখ।