প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষায় আদিবাসীদের সহযোগিতা করি
সিলভানুস লামিন
প্রকৃতি বলতে প্রাকৃতিক, ভৌত ও বস্তুগত জগতকে বুঝায়। প্রকৃতির রয়েছে বিভিন্ন উপাদান। বলা যায়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যা দিয়ে গড়া তার সবগুলোই হচ্ছে প্রকৃতির উপাদান। প্রকৃতিতে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণ ও জীবনের অস্তিত্ব ও ভিন্ন ভিন্ন জীবন রয়েছে। এককথায়, প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়তায় ভরা। এই বৈচিত্র্য মানে প্রাণ বা জীবনের অস্তিত্বের ভিন্নতা, মানুষে মানুষে ভিন্নতা, উদ্ভিদে উদ্ভিদে ভিন্নতা, প্রাণীতে প্রাণীতে ভিন্নতাসহ পৃথিবীর প্রতিটি ‘প্রাণ’ ও ‘সৃষ্টি’র মধ্যকার ভিন্নতাকে নির্দেশ করে। প্রকৃতির পাঠাশালায় হরেক রকমের উদ্ভিদ ও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। এসব জীবন ও প্রাণের প্রতিটি কর্মক্রিয়ার একটি অর্ন্তনিহিত কার্যকারণ রয়েছে। প্রতিটি ‘সৃষ্টি’র পেছনে রহস্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এই প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই একটি আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বিদ্যমান। এই আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা যত শক্তিশালী হবে ততবেশি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীসহ প্রতিটি ‘সৃষ্টি’রই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা খাদ্যের জন্য, বাসস্থানের জন্য, ওষুধের জন্য, নিরাপত্তার জন্য, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের জন্য এবং সর্বোপরি জীবনপ্রবাহকে তার আপন নিয়মে পরিচালনার জন্য! এই নির্ভরশীলতা পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য, বিকশিত হওয়ার জন্য, উৎপাদনের জন্য, নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্য এবং বেঁচে থাকার জন্য। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যময় উপাদানকে বাদ দিয়ে জীবনের ভেতরে কখনও প্রাণের সঞ্চার হতে পারে না। এই বৈচিত্র্যময়তার জন্যই তো আজও জীবন টিকে আছে। তাই মানুষের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্যই প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তবে দুঃখের সাথেই বলতে হয়, প্রকৃতিকে ধ্বংস করার দুঃসাহস কোন উদ্ভিদ বা বন্য প্রাণী দেখায়নি; দেখিয়েছি আমরা সৃষ্টি সেরা জীব মানুষ! আমাদের উন্নয়ন করার স্বার্থে আমরাই এই বন্ধন ছিন্ন করেছি, প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি। তাই তো আজ বিশ্বে হাজার হাজার প্রাণ ও জীবনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। এই বিলুপ্তি কোনভাবে আমাদের কল্যাণ করেনি; করেছে বিপদগ্রস্ত।
অন্যদিকে আমরা ছ্টোকালে স্কুলের বিজ্ঞান বইয়ে পড়ে জেনেছি যে, ‘আমাদের চারপাশ যা দিয়ে গঠিত তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। ‘পরিবেশ’ প্রত্যয়টির পরিধি ব্যাপক। কারণ পরিবেশ হতে পারে প্রাকৃতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। বস্তুত পরিবেশ হচ্ছে একটি অবস্থা; সেটি অনুকূল বা প্রতিকূল হতে পারে। তাই বলা হয়, The sum total of all surroundings of a living organism, including natural forces and other living things, which provide conditions for development and growth as well as of danger and damage is environment. মানুষ মূলত পরিবেশ থেকেই শিখে নেয় তার জীবনযাপনের কৌশল ও পন্থা। যে মানুষ সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করে তাঁর সৃজনশীলতা, সম্ভাবনময়তা ও ভাবনা অনেক বেশি গভীর। তাই তো দেখা যায়, কোন কিছু আবিষ্কার, উদ্ভাবন বা সৃষ্টির জন্য সমৃদ্ধ পরিবেশ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য থেকেই মানুষ অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা পায়। পৃথিবীতে নানান প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য আছে বলেই কবি বা সাহিত্যিকদের কলমের আঁচড়ে প্রাণ ও প্রকৃতির জীবনঘনিষ্ঠ ‘সম্পর্ক’ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়; শিল্পীদের তুলিতে জীবন ও প্রাণের অদ্ভুদ সৌন্দর্য ফোটে ওঠে। প্রাকৃতিক পরিবেশে এখনও বৈচিত্র্য আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর! উদ্ভিদে উদ্ভিদে, প্রাণীতে প্রাণীতে এবং মানুষে মানুষের ভেতরে এই বৈচিত্র্যময়তা পৃথিবীকে অনন্য একটি রূপ দিয়েছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে আদিবাসীদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃতি ছাড়া আদিবাসীদের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। প্রকৃতির একদম নিকটে বসবাসের কারণেই আদিবাসীরা এখনও স্থায়িত্বশীল, কার্বন নিরপেক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে কার্বন-নেতিবাচক জীবনযাত্রা পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আদিবাসী মানুষেরা দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করে আসছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে এই আদিবাসী মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৩০ লাখ, যা পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, জীবনপ্রণালী প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। একটি আদিবাসী শিশু জন্মের পর থেকে প্রকৃতির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। কারণ এই প্রকৃতির কাছেই তারা প্রয়োজনীয় সবকিছুই পেয়ে থাকে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি, জ্বালানি, আসবাবপত্র, ঔষধ, খাবার-দাবার সবকিছুই আদিবাসীরা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে থাকে। আদিবাসীরা পাহাড়ের বুকে আশ্রয় নিয়ে নতুন স্বপ্ন রচনা করতে প্রয়াসী হয়, পাহাড়-গাছপালা, লতাপাতা, পশুপাখি, ঝরণা, ছড়া থেকে শিখে নেয় তাদের জীবন ও জীবিকাকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল।
আদিবাসীরা বন ধ্বংস করে না, করতে পারে না। সারা বিশ্বের মানুষ যখন কোন না কোনভাবে প্রাণবৈচিত্র্য হরণ ও প্রকৃতি বিনাস প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সেখানে আদিবাসীরা পাহাড়-বন-জঙ্গলনির্ভর জীবন পদ্ধতি পরিচালনা করে প্রকৃতি ও পরিবেশকে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে অবদান রেখে চলেছেন। আমরা সবাই কমবেশি জানি যে, বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী মানুষের জীবন-জীবিকা অনেকাংশে প্রাকৃতিক সম্পদকেন্দ্রিক। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্যতা তাদের জীবন ও জীবিকাকে যেমন সহজতর করে তুলে তেমনি এসব প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হলে, অপ্রতুল হলে তাদের এই জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হতে বাধ্য। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানান দুর্যোগ প্রকৃতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্যচμ এবং জীবনকে ব্যাহত করেছে। কোন কোন প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে খাদ্যশৃঙ্খলে নানান পরিবর্তনের কারণে। আবার কোন কোন প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিও পরিলক্ষিত হয়েছে, যা প্রকৃতির পরিবেশকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়ায় প্রকৃতিতে সম্পদের যোগান কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আদিবাসীদের নিজস্ব কৌশল ও উদ্যোগ রয়েছে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনে তারাই সবচে’ বেশি ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হচ্ছেন সেহেতু এ পরিবর্তন মোকাবিলা করে কীভাবে নিজের জীবন-জীবিকা ধরে রাখা যায় সে বিষয়ে আদিবাসীদের নিজস্ব জ্ঞান ও কৌশল রয়েছে। এসব কৌশল ও জ্ঞানের গুণেই এত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও তারা আজও টিকে আছেন, আজও নিজেদের জীবন-জীবিকা পরিচালনা করছেন।
আদিবাসীরা তাদের পুষ্টি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক এবং আত্মিক অস্তিত্বের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই নিজের প্রয়োজনেই তাদেরকে প্রকৃতি ও বন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রকৃতিতে দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে গত কয়েক দশক থেকেই আদিবাসীরা প্রথমবারের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা তাপমাত্রার পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত ও তুষারপাতের গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন এবং ঋতুর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে আসছে সেই দীর্ঘদিন থেকে। তাদের এই বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যবেক্ষণ, জ্ঞান ও অনুশীলনগুলো যার সাহায্যে তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে অভিযোজন করে আসছে সেগুলোকে কোনভাবে ছোট করে দেখা উচিত নয়। কারণ এই জ্ঞান, অনুশীলন ও পর্যবেক্ষণের গুণেই অনন্য জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তারা হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারছেন।
আদিবাসীরা তাদের জীবনের মাধ্যমে বন রক্ষা করে চলেছে। মজার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে বর্তমানে যেখানে বন রয়েছে সেখানে আদিবাসীদের বাস রয়েছে। সেটা সুন্দরবন, মধুপুর, সিলেটের পাহাড় ও টিলা সব এলাকাতেই বিভিন্ন আদিবাসীরা বসবাস করে এসব বনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বন সংরক্ষণ এবং জীবিকার তাগিদে নতুন বন সৃষ্টির মাধ্যমে আদিবাসীরাই পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। এসব বন এবং বনের বিভিন্ন উপাদান তথা উদ্ভিদ, প্রাণীসহ নানান অণুজীব মানুষের কল্যাণ বয়ে এনেছে। আদিবাসীরা এসব প্রাণবৈচিত্র্য স্মরণাতীত কাল থেকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করে আসছেন। তাই পাহাড়, বন ও বৃক্ষ সংরক্ষণ ও রক্ষার মাধ্যমে মানবসভ্যতায় আদিবাসীদের বিশাল অবদান রয়েছে। কেননা প্রকৃতি, পরিবেশ ও বন ধ্বংস করার সাথে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই; বরং প্রকৃতি ও বনকে জীবনের অন্যতম বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করেই তাদের জীবন ও জীবিকা পরিচালনা করেছেন; প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করেছেন অনেক সেবা এবং বিনিময়ে প্রকৃতি ও বনকে রেখেছেন সজীব ও জীবন্ত।