শ্বেত করবী’র কাফেলা

নেত্রকোনা থেকে রনি খান
গাছ কী? গাছ কেনো? গাছ কি শুধুই অক্সিজেনের উৎস? তার সম্পর্ক কি কেবলই মানুষের সাথে? মানুষের সাথে তার সম্পর্ক কি কেবলই দেনা-পাওনার? না কি এর চেয়েও বড়ো কিছু? এতো বড়ো কিছু যেটা আমরা সাধারণ্যে এখনো বুঝতে পারি নি! যা ‘লার্জার দ্যান থিংক’! আড়িয়াল খাঁ পাড়ের জগদীশ বোস যে দিন বলেছিলেন ‘গাছেরও প্রাণ আছে’ মানুষ তো সেদিন ‘তব্দা’ খেয়েছিলো। ‘তব্দা’ তো মানুষ আবার খেয়েছে এই কিছুদিন আগেই! যখন আমরা ভিডিও’র মাধ্যমে চাক্ষুষ দেখলাম ‘গাছেরাও ভাব বিনিময় করে!’ এই তব্দার ঘোর মাথায় নিয়েই চলুন ঘুরে আসা যাক প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত। সুদূর যাদুবিদ্যা’র মোহ থেকে আধুনিক ‘সায়েন্স ফিকশন’ পর্যন্ত। চর্যাপদের শ্লোক থেকে ‘অ্যাভাটার’ এর দুনিয়া পর্যন্ত। পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআন হোক কিংবা পবিত্র বাইবেল, ত্রিপিটক অথবা বেদ’র শ্লোক, গৌতম বুদ্ধের সন্যাস যাত্রা কিংবা যিশু খ্রিস্টের ‘মরা গাছের ফল’ মানব সভ্যতার এ যাত্রায় বৃক্ষের উপস্থিতি আশ্চর্যরকম অনিবার্য এবং একই সাথে গৌরবময়।


ঠিক এরকম একটি গৌরবেরই নাম ‘শে^তকরবী’। তবে হ্যাঁ, নিশ্চয় যে কোন শে^তকরবী নয়। আমরা এখানে যে শে^ত করবীর কথা বলতে চাইছি সেটি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সূফি সাধক হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি (রঃ) এর রওজায় কাঁচের এক ছোট্ট প্রকোষ্ঠে বাঁধানো। আজ সে নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ এক টুকরো কাঠ। কাঁচের সে প্রকোষ্ঠের সামনে কংক্রিটে বাঁধানো নাম ফলকে লিখা রয়েছে এই শে^তকরবীর ইতিহাস। মধ্যযুগে যে সমস্ত সূফি সাধকেরা এই বঙ্গে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি (রঃ)। নামফলকের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, মহান এই সূফি সাধক নিজে এই শে^তকরবী গাছের ‘লালন-পালন’ করতেন। এই গাছে লেগে আছে ‘তাঁর স্পর্শ’। ফলে এই গাছের এক ‘আধ্যাত্মিক গুরুত্ব’ও রয়েছে।


একদা এই শে^তকরবীর পাশেরই বট, বকুল, তেঁতুল, গাব, গামাড়ির, বিছুটি আরো নানান নাম না জানা বৃক্ষ-গুল্মের দুনিয়া ছিলো এই অঞ্চল। বৃক্ষের সাথে ছিলো নাম না জানা নানান প্রাণী। পাশ দিয়ে বয়ে চলা জিতাই নদী, নদীর মোহনা। মানুুষ, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, নদী মিলে তৈরি করেছিলো আধ্যাত্মিক এক জগৎ। সে জগতের অনেক কিছুই আজ বিলুপ্ত। যেমন মৃত এই শে^তকরবী। তবে কালের স্বাক্ষী হয়ে ইতস্তত এখনো দাঁড়িয়ে আছে বট-বকুল-তেঁতুল, গাব-গামাড়িরা। আর সগৌরবে ঘোষণা দিচ্ছে তারাও সেই শে^তকরবী’র কাফেলারই সদস্য।


হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি (রঃ) এঁর রওজাটি অবস্থিত নেত্রকোনা সদর উপজেলা’র মদনপুর গ্রামে। যেখানে প্রতিবছর ফাল্গুনের পূর্ণিমাতে জমে উরস। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে, হাল বাওয়া খেতের আল দিয়ে, রাজপথ দিয়ে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতি বছর এই উরসে জমা হয় হাজার, হাজার মানুষ। যারা এই বট-তেঁতুলের নিচে তৈরি করে তাদের অস্থায়ী কাফেলা। কাফেলায় রাতব্যাপী হয় সঙ্গীত। সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ¯্রষ্টার সাধনা। ¯্রষ্টার সাথে প্রেম আর মাহাত্ম্যের আরাধনা।


এভাবেই তো যুগে যুগে গাছ মানুষের পরম বন্ধু হয়ে রয়েছে। শুধুমাত্র মানুষ কেনো? প্রকৃতি’র সকল প্রাণের সাথে বৃক্ষ পরম বন্ধু হয়ে জড়িয়ে রয়েছে। এ সম্পর্ক শুধুমাত্র আদান-প্রদানের নয়। এ সম্পর্ক নির্ভরতার, এ সম্পর্ক শান্তির। এই সম্পর্কের উপর ভর করেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দুনিয়ার অস্তিত্ব।


‘শিল্পবিল্পব’র নামে ‘প্রতিবিপ্লব’কে বাদ দিলে গাছের সাথে মানুষের ‘পিরিতি’ অঙ্গাঅঙ্গি, বেশ রঙিন এবং প্রাচুর্যময়! গাছ মানুষের নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, নিবিড় বন্ধু, উত্তম আশ্রয়, উন্নয়নের প্রথম সিঁড়ি। উন্নয়নের প্রথম সিঁড়ি যেমন গাছ, তেমনি তথাকিথত উন্নয়নের প্রথম ‘শহীদ’ও এই গাছ। দুনিয়ার নানা প্রান্তে গাছকে কোরবানী দিয়ে আমরা তৈরি করছি উন্নয়ন বিলাসি এক রঙিন ‘স্বর্গ’। যে স্বর্গ নরকের খড়্গ হয়ে আমাদেরই দিকে ধেয়ে আসছে বারবার।

আমাদের অস্তিত্বকেই প্রশ্ন করছে। এ মহাবিশে^ প্রাণের বাসযোগ্য একমাত্র পৃথিবীকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে।
আশার কথা হচ্ছে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম এর দায় নিচ্ছে। আগামীর পৃথিবীটা তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এরকমই একটি উদ্যোগ নিয়েছে নেত্রকোনা অঞ্চলের যুবদের সংগঠন নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ। তারা নেত্রকোনা অঞ্চলের শতবর্ষী বৃক্ষ চিহ্নিত করে তা রক্ষার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তাতে সহযোগিতা করছে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বারসিক।


এভাবেই স্থানীয়-রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ের সচেতন উদ্যোগ, পারস্পারিক সহযোগিতা শান্তির সমৃদ্ধ পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে বলে উদ্যোক্তাদের বিশ^াস। যেভাবে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে টিকে আছে আমাদের এই প্রকৃতি। প্রকৃতি’র এই পাঠ গ্রহণ করতে হবে। নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রকৃতিঘনিষ্ট প্রাকৃতজনেরা যেমন ছড়া কেটেছেন: ‘এক পিরিতি কইরাছিলো ডাউ¹ার সাথে ফাত (কলাপাতা)/ ফুর্দা ফুর্দা (ছিঁড়ে কুঁচি কুঁচি) হইয়া গেলো/ তেও না ছাড়ে সাথ।’

happy wheels 2

Comments