সবুজ পৃথিবীতে তোমাকে স্বাগতম
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
গ্রামের কোন পরিবারে মায়ের নতুন সন্তান জন্মালেই লাবণী, শেফালি, দিপালী, সনিয়া, প্রীতি, তৃপ্তি, রুমা, শিমু, কথা, পাপিয়ারা গাছের চারা নিয়ে ছুটে যায় সন্তানকে এ ধরায় আগমণের জন্য স্বাগত জানাতে। গ্রামের সকল নবাগতদেরকে সবুজ ধরায় এভাবেই স্বাগত জানায় তারা। এরা সবাই শিক্ষার্থী। এদের কেউ কেউ হাই স্কুলের, কেউ কলেজের আবার কেউ মাষ্টার্স পাশ করে চাকরির সন্ধান করছে।
নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের ২০ জন কিশোরী ও যুবরা একটি ব্যতিক্রমী সংগঠন গড়ে তুলেছে। গ্রামের কোন মা সন্তান জন্ম দিলে তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি স্থানীয় ফলদ ও একটি ঔষধি গাছের চারা দিয়ে এ ধরণীতে তাকে স্বাগত জানায়। এ কিশোরীদের কথা ‘হে মানব সন্তান তোমাকে আমাদের এই পৃথিবীতে স্বাগতম। তুমিই গড়ে তুলবে একটি সবুজ সুন্দর বাংলাদেশ।’ শুধু স্বাগতই জানায় না, গ্রামের গর্ভবতী নারীদের গর্ভাবস্থায় পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্যও তারা বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। গ্রামেই পাওয়া যায় বিভিন্ন কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য (শাক-সবজী, ফল-মূল), প্রতি সপ্তাহে সেগুলো কুড়িয়ে কিশোরীরা গর্ভবতী মাকে রান্না করে খেতে দিয়ে আসে। এভাবে তারা কোনদিন গিমাই, কচুশাক, কচু লতা, হেলেঞ্চা, পালই, কলার মোঁচা, বথুয়াশাক, লেবু, কলমিশাক, দলকলস শাকসহ গ্রামের আনাচে কানাচে যেখানে যা পাওয়া যায় এবং পুষ্টিকর ও বিষমুক্ত সেইসব খাবার বাড়িতে দিয়ে আসে। তারা এগুলো সেইসব নারীর জন্যই দিয়ে এই সেবাটা দিয়ে থাকে, যারা পিছিয়ে পড়া ও বাজার থেকে কিনে পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেনা।
কিশোরীরা তাদের জমানো টাকা থেকে মুরগির ডিম কিনে এক মাসের জন্য গর্ভবতী নারীকে দিয়ে সহযোগিতা করে। গ্রামের গর্ভবর্তী নারী, শিশু, কিশোরীদের টিটি টিকা, সেবা পরিসেবাসমূহের তথ্য, ওজন মাপা, পুষ্টি তথ্যসহ বিভিন্নতথ্য তারা তাদের কিশোরী তথ্য কেন্দ্র থেকে দিয়ে থাকে। কিশোরী সংগঠনটি প্রতি মাসে গর্ভবতী মায়েদেরসহ সকল গ্রামবাসীদের সাথে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, শিক্ষ, সংস্কৃতি ও সামাজিক সচেতনতামূলক বিভিন্ন ইস্যুতে গ্রাম সভার আয়োজন করে থাকে। সংগঠনের মাসিক সভায় আলোচনার ভিত্তিতে তারা পরবর্তী করণীয় বিষয় ঠিক করে।
গত বছর গ্রামের প্রাণবৈচিত্র্যের পরিস্থিতি জানার জন্য সংগঠনের উদ্যোগে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপ থেকে দেখা যায়, গ্রামে ফলের বৈচিত্র্য ও ফলজ গাছের সংখ্যা খুব কম। তাই তারা চলতি বছর জুন মাসে গ্রামে ১০০টি বৈচিত্র্যময় ফলের চারা রোপণ করেছে। গ্রামের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি সন্মানজনক অবস্থান তৈরি এবং সমাজে প্রবীণদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদান ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণে নতুন প্রজন্মের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংগঠনটি প্রবীণ ও যুবদের নিয়ে সচেতনতামূলক আলোচনার আয়োজন করে।
শিশু, প্রবীণ ও নারীদের জন্য একটি সুষম সমাজ তৈরির জন্য কিশোরী সংগঠনের এ উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। শিশুর পুষ্টি ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসকরণে এবং শিশুর জন্য প্রাকৃতিক নির্মল পরিবেশ রচনায় সংশ্লিষ্ট পরিবারকে ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা দিয়ে কিশোরী সংগঠনের সদস্যদের এ সহায়তা শুধু এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়নেই সহায়তা করছে না, পাশাপাশি তারা বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়নের ৩ নং, ৫ নং ও ১৩ নং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও অবদান রাখছে। নারী হয়েও কিশোরী সংগঠনের এধরণের উদ্যোগ বাংলাদেশের সকল অঞ্চল ও নারী সমাজের জন্য উদাহরণ।