বিলীন হতে চলেছে শিশুদের খেলা চড়ুঁইভাতি

সাতক্ষীরা থেকে ফজলুল হক
চড়ুঁইভাতি কথাটির নাম শুনলে অনেকে মনে করেন, চড়ুঁই পাখির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া। আসলে তা নয়; এটা হলো গ্রাম বাংলার শিশুদের একটি খেলার নাম। অনেক বাচ্চা এক সাথে মিলিত হয়ে ভাত, তরকারি, মাংস রান্না করাকে চড়ুঁইভাতি বলে।IMG_20170822_173257 এক সময়ে গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চারা এক সাথে মিলিত হয়ে বাড়ির উঠানে বা খোলা মাঠে চড়ুঁইভাতি করতে দেখা যেতো। শিশুরা চড়ুঁইভাতি করতে অনেক আনন্দ পেতো। বিশেষ করে স্কুলের ছুটির দিনে বেশি করতে দেখা যেত চড়ুঁইভাতি।

চড়ুঁইভাতি করতে গিয়ে সবার ছোট ছোট অংশগ্রহণ থাকতো। কোন জিনিসই কেনা হতো না। সবাই বাসা থেকে রান্নার উপকরণ নিয়ে আসতো। কেউ আনতো চাল, কেউ ডাল, কেউ মাছ, কেউ ডিম, কেউ মাংস, কেউ তরকারি, কেউ পেঁয়াজ, কেউ রসুন, কেউ কাঠ প্রভৃতি। পাশাপাশি, প্রতিটি কাজও নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিতো হতো। এখানে বেশি বয়স্কদের অংশগ্রহণ থাকতো। সবাই থাকতো সমবয়সী।

আয়রে খোকা, আয়রে খুকি
চড়ুঁইভাতি খেলি
সবুজ ঘাসের ঐ বাগিচায়
পা-দু খানি মেলি।

চড়ুঁইভাতির সামগ্রী সংগ্রহ করা বিষয়টি যেমনি মজার তেমনি আগ্রহোদ্দীপক। বাচ্চারা সিদ্ধান্ত নিলো যে চড়ুঁইভাতি করবে। তখন তারা নিজ নিজ বাড়ি গিয়ে মা-বাবাদের কাছে বলতো। অনেক মা-বাবারা চড়ুঁইভাতি করতে দিতো। অনেক মা-বাবা করতে দিতো না। আবার চড়ুঁইভাতির কথা বললে মা-বাবা বাচ্চাদের তাড়া দিতো, বকা দিতো। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাকে না বলে চড়ুঁইভাতির প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতো।

এই সকল প্রতিবন্ধকতা এবং অভিযান এর মধ্যে দিয়েও চড়ুঁইভাতি শুরু করতো বাচ্চারা। তারা নিজেরাই রান্না করতো। কখনো ভাত ফুটতো না, তরকারি সিদ্ধ হতো না। তবুও আনন্দ পেতো বাচ্চারা। এক সময়ে কোমলমতি শিশুদের বিনোদনের খোরাক যোগাতো এই চড়ুঁইভাতি নামক রান্নাবাটির খেলাটি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গ্রাম বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরির্বতনের ফলে গ্রাম বাংলার চড়ুঁইভাতি এখন কম চোখে পড়ে।

একদিন হঠাৎ করে দেখা মিলল সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের মাছখোলা গ্রামে। ৯-১০ জন ছোট ছোট বাচ্চারা চড়ুঁইভাতি করছে। দেখে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, তারা অনকে আনন্দ পাচ্ছে। তারা রান্না করার জন্য ইট দিয়ে চুলা তৈরি করেছে। আর রান্নার চারপাশ ঘিরে গোল হয়ে বসে ছিল বাচ্চারা।

IMG_20170822_173209

মো. আবির হোসেন (৯) এর কাছে চড়ুঁইভাতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলে, “আমার দাদা-দাদী, নানা- নানীদের কাছে অনেক বার গল্প শুনেছি চড়ুঁইভাতি খেলার। কিন্তু কোন দিন খেলা হয়নি। এই প্রথম খেলছি- খুব ভালো লাগছে আমার।”

এই চড়ুঁইভাতি সর্ম্পকে মাছখোলার সাথী আক্তার বলেন, “আমার ছেলেও আছে, হঠাৎ করে আমাকে বলল মা আমাকে এক মগ চাল, ১টা ডিম, ২টা পেঁয়াজ দিতে হবে। আমি বললাম, কি করবা? ছেলে বলল, রান্না করবো আমরা। আমি তার কথা মত দিলাম।” তিনি আরো বলেন, “সবচেয়ে মজার বিষয় হল চাল, ডাল, আলু, ডিম, পেঁয়াজ এক সাথে করে পানি দিয়ে রান্না করছে।”
মাছখোলা বেতনা নারী সংগঠনের সভানেত্রী আশুরা খাতুন বলেন, “মাছখোলা গ্রামে আনেক দিন পর বাচ্চাদের চড়ুঁইভাতি দেখলাম। আমরা যখন ছোট ছিলাম প্রায় চড়ুঁইভাতি খেলতাম। কিন্তু দিনদিন যেন হারিয়ে যাচ্ছে- বছরে দুই একবার চোখে পড়ে চড়ুঁইভাতি।”

মাছখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল এর কাছে চড়ুঁইভাতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চড়ুঁইভাতি খেলাটি ছোট ছেলে-মেয়েদের খুবই মজাদার একটি খেলা। আমি ছোট বেলায় অনেক বার চড়ুঁইভাতি খেলাটি খেলছি- অনেক মজা করেছি। কিন্তু এখন গ্রামে খুবই কম চোখে পড়ে চড়ুঁইভাতি খেলাটি। তিনি আরো বলেন, “চোখে পড়বে কি? এখন গ্রামের অধিকাংশ বাবা-মায়েরা চড়ুঁইভাতি খেলাটি খেলতে দিতে চায়না। কেউ বাচ্চাদের মনেও করিয়ে দেয় না- চড়ুঁইভাতি কথা।”
ছোট ছোট শিশুদের বিনোদনের একটি নাম চড়ুঁইভাতি। এটি শিশুদের সমবায়, সমঅংশগ্রহণ এবং সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শেখায়। পাশাপাশি সহভাগিতা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে। গ্রাম বাংলার বাচ্চাদের এই খেলাটি ধরে রাখার জন্য আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।

happy wheels 2

Comments