প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যস্ত জনজীবন
কলমাকান্দা, নেত্রকোণা থেকে অর্পনা ঘাগ্রা
এই বছরের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়েছিল অকাল বৃষ্টি। টানা প্রায় দুই সপ্তাহের ভারী বর্ষণে শুরু হয়েছিল পাহাড়ি ঢল। আর সেই ঢলে হাওরঞ্চলে ব্যাপক ফসল হানি হয়েছিল। পরবর্তীতে শুধু ফসল নয়; পানিও দূষিত হয়ে জলাশয়ের প্রাণবৈচিত্র্যর অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছিল। সেই সময়কার প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল হারানো এইসব কৃষক আজ বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কোথাও বেড়েছে শিশু ঝড়ে পড়ার হার, কোথাও বেড়েছে শিশু শ্রম, কোথাও সংকট দেখা দিয়েছে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে, কোথাওবা আবার উদ্বাস্তু হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো।
কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামে ১২৬টি পরিবারের প্রায় প্রতিটি পরিবারই কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে নির্ভরশীলতার ধরনে রয়েছে ভিন্নতা। কোন কৃষক নিজের জমিতে ধান উৎপন্ন করে, কোন কোন কৃষক অন্যের জমি টংক বা বর্গা নিয়ে ধান উৎপন্ন করে। আবার কেউ অন্যান্য কৃষকদের উৎপাদিত ধানের জমিতে শ্রম দিয়ে সারাবছরের খোরাক সঞ্চয় করে থাকে। এই গ্রামের ফসলী জমি বছরের ৬-৭ (জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক) মাস পর্যন্ত জলে নিমজ্জিত থাকে। তারা শুধুমাত্র বোরো মৌসুমে ধান চাষ করতে পারেন এবং শীতকালীন শাক সবজি চাষ করতে পারেন। এই বোরো ফসলের উপরই নির্ভর করে তাদের জীবন জীবিকার মান।
এই গ্রামের জনগোষ্ঠীদের ভাষ্যমতে প্রতিবছরের তুলনাই এই বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ঘর ছেড়েছেন। প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি জমিয়েছেন। তার মধ্যে ৫টি বা তারও বেশি পরিবার উদ্বাস্তু হয়েছেন। এখনও বেশ কিছু পরিবার যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। প্রায় ৩৩ জন বা তারও বেশি শিশু স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ে শিশু শ্রমে নিয়োজিত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ রিক্সা চালায়, কেউ ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে, কেউ রঙ মিস্ত্রির কাজ করে, কেউ গার্মেন্টেসে, আবার কেউ কেউ গৃহশ্রমিকের কাজ করেন।
এই গ্রামেরই কৃষাণী আকলিমা আক্তার বলেন, “আমার ৮ কাঠা (৬৪ শতাংশ) জমির সবগুলো ধান পানিতে তলাইয়ে গেছে। এই জমির ধান দিয়াই আমাগো সারাবছরের খোরাক চলতো। এহন ধান নাই, গরুর লাইগা খড়ও নাই। তাই গরু বিক্রি কইরা ফেলছি। স্বামী অসুস্থ কাজ করতে পারেনা। তার চিকিৎসাও ঠিকমত করতে পারতাছিনা। ঈদের সময় বাচ্চাদের লাইগা জামাও কেনা হয় নাই।”
একই ইউনয়নের চিনাহালা গ্রামের কৃষক জজ মিয়া ও ফাতেমা বেগমের সংসারে ৫টি মেয়ে সন্তান আছে। ফসল হারিয়ে তারাও অভাব অনটনের মাঝে দিনাতিপাত করছেন। সংসারের সদস্য সংখ্যা কমাতে বড় মেয়েকে বাল্য বিবাহ দিয়ে দিয়েছেন। তাকে বিয়ে দিতে গিয়ে তার জীবিকার একমাত্র সম্বল রিক্সাও বিক্রি করে দিয়েছেন। পাশাপাশি তার পরের ২ মেয়েকে অগ্রিম ৪০,০০০ টাকার বিনিময়ে ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। যতদিন পর্যন্ত তা পরিশোধ না হয় ততদিন পর্যন্ত মেয়ে দুটোকে সেই বাসাতেই কাজ করতে হবে।
এছাড়াও এই গ্রামের অধিবাসীরা জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ধান পচে পানি দূষিত হয়ে গেছে। তাই তারা নদী ও বিলের পানিতে স্নান করলেই বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের গৃহপালিত হাঁস-মুরগির মৃত্যু দূর্যোগের রূপ ধারণ করেছে। কেউই হাঁস-মুরগি বাঁচাতে পারছেনা। রোগে আক্রান্ত হওয়া মাত্রই মূহুর্তের মধ্যে সব মারা যাচ্ছে। চিকিৎসা করার সময় পর্যন্ত পাচ্ছেনা। এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র এই গ্রামই নয় আরো অনেকগুলো গ্রামেই। তাই এলাকায় প্রাণিসম্পদ কমতে শুরু করেছে।
একই ইউনিয়নের সোনাডুবি হাওরপাড়ে অবস্থিত হরিণধরা গ্রামে প্রায় ১০৫টি হিন্দু পরিবারের বসবাস। তারা বৈশাখ মাসে বৈশাখী সংক্রান্তী, লক্ষ্মী পূজা, জৈষ্ঠ্য মাসে জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি, করমাদি বর্ত, আষাঢ় মাসে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাস্তমী, শ্রাবণ মাসে শ্রাবণী পূজা, ভাদ্র মাসে তাল নমিনী ও বুড়া-বুড়ি পূজা করতো। এইসব ধর্মীয় পার্বণ উদ্যাপন করার জন্য উপকরণ ক্রয় বাবদ অনেক খরচ করতে হয়। সেই খরচের টাকা জোগাড় করতে না পেরে এই বছর এইসব ধর্মীয় পার্বণগুলো পালন করা হয়নি এই গ্রামের অধিবাসীদের। সামনে আসছে আশ্বীন মাস অর্থ্যাৎ দূর্গা পূজাঁ। দূর্গা পূজাঁ উদ্যাপনের বিষয়ে এই গ্রামের অধিবাসী জীবন তালুকদার বলেন, “দূর্গা পূজার সময় আমরা প্রত্যেক বাড়ি থেকে ২০০-১০০০/- টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলি। যার যার সামর্থ্য মত টাকা দেয়। কিন্তু এই বার কেউ ধান পায় নাই। তাই কারোরই চাঁদা দেয়ার সামর্থ্যও নাই। আমরা এইবার দূর্গা পূজাও করতে পারবোনা।” বর্তমানে এই গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীই প্রায় ২-৩ মাস পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারছেনা। কারণ অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের ট্রলার ভাড়া দিতে পারছেনা।
প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল হানির প্রভাব শুধুমাত্র এই কয়েকটি গ্রামের কয়েকটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ব্যাপকতা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার প্রতিটি পরতে পরতে চরম আঘাত হানছে প্রতিনিয়ত। যেমন এইবারের কোরবানি ঈদে অনেক শিশু নতুন জামা পরতে পারেনি, অনেক প্রবীণদের সুচিকিৎসা হচ্ছেনা, অনেক গর্ভবতী মায়েরা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেনা, গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় গোয়ালশুন্য হতে শুরু করেছে, পারস্পরিক বিনিময় প্রথা কমে গেছে। এবারের ঈদের সময় দাওয়াত দেওয়া ও দাওয়াত রক্ষা করা কমে গেছে। মানুষের খাদ্যাভাসের নিম্নমূখী পরিবর্তন দেখা দিয়েছে প্রভৃতি। এই সংকট নিরসনে রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের বিত্তশালী সহ সবারই মানবিকতার মানষিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।