নির্ভরশীলতা ও বৈচিত্র্য সুরক্ষায় বৈচিত্র্যময় ফল বাগান
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তায় স্থানীয় জাতের ফল অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। একসময় উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের প্রতিটি কৃষিবাড়িই ছিল এক একটি সমন্বিত কৃষি খামার। যেখানে দেখা যেত স্থায়িত্বশীল কৃষির পাশাপাশি দেশীয় নানা জাতের ফলজ গাছের বাগান। কালের ¯্রােতে উপকূলীয় কৃষি তথা দেশীয় ফলজ বাগানের চরম সংকট দেখা দেয়। শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে উপকূলীয় কৃষির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রতিবেশ উপযোগি মৌসুমি দেশীয় ফল গাছ। দেশের উপকুলীয় অঞ্চলের কৃষি বাড়িতে কিছু কিছু দেশীয় ফল গাছ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ফল গাছ বিলুপ্তির পথে। স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরপুর বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় ফলজ গাছ সুরক্ষায় অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের কৃষানী অল্পনা রানী (৪৪) নিজের প্রচেষ্টায় টিকিয়ে রেখেছেন কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কৃষিবাড়ি। একই সাথে নিজের মাত্র ৩৩ শতক বসতভিটায় বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি উৎপাদন ও কৃষি চর্চার পাশাপাশি লাগিয়ে রেখেছেন নানা জাতের দেশীয় ফল গাছ। নিজের আঙিনাকে সাজিয়েছেন স্থানীয় জাতের ফল গাছ দিয়ে। অল্পনা রানী তার বসতভিটার চার পাশে আম (গোবিন্দভোগ, আ¤্রপালি, হিমসাগর, বারমাসি আম, নিলাম্বরী, লতা) জাম, কলা (সবরী, কাঁচকলা, কাঁঠালে, বড়বাউলে, ঠুটে, ডয়রা) নারকেল, পেঁয়ারা (দেশী, কেজি ও লাল), টক আমগা, পানি আমড়া, সবেদা, জামরুল (সাদা ও লাল), বাতাবি লেবু, ডাবো, ডুমুর, তাল, খেজুর, করমচা, কেওড়া, কদবেল, পাতিলেবু, আঙুর, লিচু, আপেল, কুল (নারকেল, টককুল, বিলিতে), তেঁতুল, আঁশফল, জলপাই, গবেদা, কমলালেবু, ডালিম, বেদানা, কাঁঠাল, সুপারি, পেঁপে, গাব গাছ, দেশী বেল, আতা, আমলকি, হরিতকি, বহেরা, সহ প্রায় ৬০ প্রজাতির দেশীয় ফল।
অল্পনা রানী বৈচিত্র্যময় ফলজ বাগান দেখার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিবর্গ, সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ পরিদর্শনে আসেন। নিজের বাগানের মৌসুমী ফল নিজেদের পারিবারিক চাহিদা পূরণ, আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ এর মাধ্যমে আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাড়িতে নানা জাতের ফল গাছ লাগানোর ব্যাপারে কৃষানী অল্পনা রানী বলেন, “আগে আমাদের এলাকায় নানা ধরনের দেশীয় ফল গাছ দেখা যেত, এখন দেখা যায় না, এগুলো লাগানোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজার থেকে আমাকে কোন ফল কিনতে যেন না হয়।” তিনি আরও বলেন, “নিজের বাগানের বিষমুক্ত ফল খেতে পারি, সেই সাথে বড় ধরনের খরচের হাত থেকে রক্ষা পাই। এসকল ফলজ বাগান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বারসিক আমাকে বিশেষ সহযোগিতা করেছে।”
অল্পনা রানীর এক ছেলে ও এক মেয়েসহ মোট ৪ জনের সংসার। স্বামী ও সন্তানের সহযোগিতায় গৃহস্থালীর কাজ, বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন, প্রাণী সম্পদ পালন এবং সমন্বিত কৃষি কাজ (পাতার চাতর তৈরি, ধান রোপন, ধান কাটা মাড়াই, বীজ সংরক্ষন) সহ সব ধরনের কাজ করেন। স্থানীয় ফলজ বনায়নের পাশাপাশি ঔষধি উদ্ভিদবৈচিত্র্য হিসেবে অনন্তমূল, অপরাজিতা, ঈষাণমূল, লালকেউটে, কালকেউটে, শিউলি, সোনাঝুরি, কৃষ্ণ তুলসী, রাধা তুলসী, মাধবীলতা, যাঁতিফুল, শিষ আকন্দ, শ্বেত আকন্দ, বাউফুল, কানফুল, ঝাউগাছ, চিরবসন্ত, পাথরকুচি, দূর্বাঘাস, মেহেদী, ধুতরা, গাদাফুল অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্য হিসেবে আদাবরুন/বিলশাক, তেলাকচু, ঘুমশাক, কলমীশাক, গাদামনি শাক, হেলাঞ্চ, মাটিফোড়া শাক, খুদকুড়ো, হাতিশূর, সেঞ্চি শাক, ঘোড়া সেঞ্চি, কাটানটি, গিমে শাক, থানকুনি, কালকচু প্রদর্শনী প্লট করে সংরক্ষণ করেছেন।
কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ১৪১৯ ব্রোঞ্জ পদক গ্রহন করেন। এছাড়াও বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কারসহ আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে নানা ধরনের পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।
অল্পনা রানীর ফল বাগান উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার একটি শ্রেষ্ঠ মডেল। এলাকা উপযোগি প্রায় সব ধরনের ফলজ গাছের বাগান করে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেছেন। স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা অল্পনা রানীর বৈচিত্র্যময় ফলজ বাগান একদিকে যেমন তার পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পুরণ করে ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে অপরদিকে আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বৈচিত্র্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে।