হাতে ভাজা মুড়ির ফেরিওয়ালা
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
শীত কিংবা গরম সব সময়ই “মুড়ি লাগবে মুড়ি, হাতে ভাজা গরম মুড়ি” এমন একটি আহ্বান শোনা যায় বলাই নোওগাঁ হয়ে কাইলাটী ঘুরে নেত্রকোনা জেলা সদরের আশপাশের প্রতিটি গ্রামে। এ আহ্বানটি করেছেন সবার কাছে অতি পরিচিত সবিতার বর্মণ (৬০)। তিনি প্রায় ১২ বছর ধরে মুড়ি বিক্রি করেন। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে কখনও খালি পায়ে, কখনও চটি পায়ে মাথায় বিশাল আকৃতি মুড়ির বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ান বৃদ্ধা সবিতা বর্মন। এক যুগ পার হয়ে গেলেও তিনি এখনও মুড়ি বিক্রি করে চলেছেন। নিজেদের পাড়ার অনেক নারী তার সাথে সাথে এ পেশায় যুক্ত হলেও তাদের অনেকেই মুড়ি বিক্রয় ছেড়ে অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “মুড়ি বিক্রয়ের কাজটি সহজ নয়, মুড়ি ভাজতে ভালো লাকড়ির প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট প্রকার ধানের যেমন লাফা, আশাইরা, মুক্তা, ইরি ইত্যাদি ধানের। এসব ধানে মুড়ি ভালো হয়। তবে এসব ধান অনেক সময় পাওয়াও যায় না।
বাবা-মা’র সংসার থেকে নাড়–, মুড়ি ভাজার কাজটি শিখেছেন সবিতা বর্মণ। বিভিন্ন পূজা বা উৎসবে তিনি মায়ের সাথে মুড়ি ভাজতেন। সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েই তিনি মুড়ি বিক্রি শুরু করেন। খুব সামান্য টাকার ধান কিনে মুড়ি ভেজে নিজেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রয় করেন। স্বামীর অল্প আয় এবং আর সবিতার মুড়ি বিক্রয়ের টাকা দিয়েই তাদের সংসারের চাকা ঘুরে। দু’জনের এ আয় দিয়েই তারা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।
নেত্রকোনার চারপাশে অনেক বাড়িতে মুড়ি বিক্রি করেন সবিতা বর্মণ। তাই ওই বাড়ির বউ ঝিদের কাছে সবিতা এখন আপনজন। প্রতিটি পরিবারের সুখ দুঃখের সাথে জড়িয়ে গেছেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমার মুড়ি অনেক বাড়ির বাচ্চাদের সকালের খাবার। শীতের সময় সরিসার তেল, ধনে পাতা বা খেঁজুর গুড় দিয়ে মুড়ি খেতে অনেকেই পছন্দ করে। তারা সবসময় বলে মাসি তুমি মুড়ি বেঁচা ছাইরনা। তোমার মুড়ি আমাদের বাচ্চাদের নিরাপদে খাওয়াতে পারি।” তিনি আর বলেন, “বাজারে এখন মেশিনে ভাজা মুড়ি বেশি বিক্রয় হয়। কারণ মেশিনে ভাঙালে মুড়ির রঙ সাদা হয়। নতুন নতুন মাইনসে অনেকে হাতে ভাজা মুড়ি চেনে না। মেশিনে ভাজা মুড়ির সাথে বিভিন্ন ধরনের কেমিকেল মেশানো থাকে যা মানুষে স্বাস্থ্যের জন ক্ষতিকর, মানুষরে খাবারের সাথে বিষ খাওয়াইতেছে”।
সবিতা বর্র্মণ জানান, হাতে ভাজা মুড়িকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। যেভাবে ভেজাল খাবার আমাদের চারপাশের মানুষ গ্রহণ করছে এতে দিনদিন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাঁর একটাই বক্তব্য এই শিল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মুড়ির বাজারজাতকরণ ঠিক রাখা খুব দরকার। তিনি তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে যেতে চান বলে জানান। কারণ মুড়ি বিক্রি এখন আর তার পেশা না, অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে।
সবিতা বর্মণের স্বামী হরেশ চন্দ্র বর্মণ পেশায় একজন জেলে। ৫ ছেলে ২ মেয়ে, বৃদ্ধ শাশুড়ি, স্বামী স্ত্রী মিলে সবিতার ৯ জনের সংসার।