বহুত্ববাদ সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র-এর আত্মপ্রকাশ
কলমাকান্দা থেকে গুঞ্জন রেমা
কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের নলছাপ্রা গ্রামে বারসিক কলমাকান্দা রিসোর্স সেন্টার, সম্মিলিত যুব সমাজ ও কলমাকান্দা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির যৌথ উদ্যোগে বহুত্ববাদী সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদের আলহাজ্ব আব্দুল খালেক তালুকদার বীর মুক্তিযোদ্ধা। সভাপতিত্ব করেন ২নং নাজিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল কুদ্দছ (বাবুল)। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আফরোজা বেগম শিমু, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ারর এসোসিয়েশন এর চেয়ারম্যান ভূবন চাম্বুগং, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, আব্দুল মোতালিব উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি, সায়েদ আহমেদ খান বাচ্চু জেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি, ফৌজিয়া নাসরিন, আব্দুল রহমান ও বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান। বিভিন্ন পেশা ও জাতী গোষ্ঠীর প্রায় ২০০ জন এই উদ্বোধন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যম যদি বলা হয় তবে এই কেন্দ্রটি একটি। মানুষে মানুষে সম্পর্ক সমৃদ্ধি, বৈষম্যহীণ সমাজ গড়ে ওঠার পেছনেও এই কেন্দ্রটি কাজ করবে। বর্তমান সরকার হলো সম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী এবং এ সরকার একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারের সেই লক্ষ্য অর্জনে বারসিকও অগ্রনি ভূমিকা পালন করছে যার উদাহরণ এই বহুত্ববাদী সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র।
উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জনাব আফরোজা বেগম শিমু বলেন, বারসিক কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগটি খুবই সময়োপযোগি ও গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। এমন উদ্যোগ সচরাচর দেখা যায় না। এখানে যেসব উপকরণগুলি সংরক্ষণ করা আছে সেটি খুবই প্রশংসার দাবিদার। তবে যদি কলমাকান্দা উপজেলায় যেসব মুক্তিযোদ্ধগণ এখনো জীবিত আছেন তাদের নাম ও ছবির তালিকা এখানে রাখা হতো তবে যারা নতুন প্রজন্ম তারা অনতত এই উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের চিনতে পারবে যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি। যারা এই কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য কাজ করছেন আপনারা এটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করবেন। যদি পারি তবে আমিও আপনাদের সাথে থেকে কাজ করার চেষ্টা করবো। এই কেন্দ্রটিতে আপনারা যারা স্থানীয়রা আছেন আপনারা বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় আমাদের নিত্য ব্যবহার্য্য উপকরণগুলি সংগ্রহ করে জমা রাখবেন এতে করে এ কেন্দ্রটি আরো সমৃদ্ধ হবে। পাশাপাশি সমৃদ্ধ হবে আমাদের নতুন প্রজন্মের জ্ঞানের ভান্ডারও।
আলোচনা সভার সভাপতি তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাঙালি, গারো, হাজং ও বানাই এই ৪টি জাতিগোষ্ঠী আমার ইউনিয়নে আজ থেকে অনেক দিন থেকে এখানে ভাই ভাই সম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করছে। আমাদের এই বন্ধন বা সম্পর্কে কোন প্রকার ভাটা আমি কখনো লক্ষ্য করি নাই। কৃষিনির্ভর হওয়া সত্বেও আমাদের অনেক স্থানীয় কৃষি উপকরণ এখন আর আমরা ব্যবহার করি না। যার ফলে দিন দিন এগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। এসব হারিয়ে যাওয়া কৃষি ও সাংস্কৃতিক উপকরণগুলি সংগ্রহ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে যে কেন্দ্রটি আজ উদ্বোধন করা হয়েছে সেটি খুবই তাৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কারণ এসব উপকরণগুলিই আমাদের সংস্কৃতিকে বহন করে। অথচ এগুলি আমরা হারাতে বসেছি। আধুনিকতার ছোয়ায় যাতে এগুলি আমরা না হারিয়ে ফেলি সেদিকে আমাদের সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে আমরা সবাই কেন্দ্রটিকে আরো সয়ংসম্পূর্ণ করতে পারি এ লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে।’ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ভূবন চাম্বুগং বলেন, বারসিকের উদ্যোগে নলছাপ্রা গ্রামে যে বহুত্ববাদী সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এটি এক দিকে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে অন্য দিকে যাদুঘর বা সংরক্ষণাগার হিসেবেও কাজ করবে। যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম এখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে বুঝতে পারবে।
উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি মো: আব্দুল মোতালিব বলেন, ‘বহুত্ববাদী সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রটি আমরা যারা এলাকাবাসী আছি আমরা সবাই মিলে মিশে এটিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছি। এখানে যেসব উপকরণগুলো আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সেটি এখানকার স্থানীয় মানুষজন নিজ উদ্যোগে দান করেছেন। এ কেন্দ্রের মধ্যে সকল জাতী গোষ্ঠীর নিত্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র কৃষি উপকরণ, মাছ ধরার উপকরণ সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে যাতে নতুন প্রজন্ম এই কেন্দ্র থেকে শিখতে ও বুঝতে পারে। কারণ এখন আমাদের ব্যবহৃত অনেক উপকরণ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলো স্মরণে রাখার জন্যই আমাদের এমন উদ্যোগ। জেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি সায়েদ আহমদ খান বাচ্চু বলেন, ‘বহুত্ববাদী সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে আমাদের সকল জাতি, শ্রেণী, পেশার মানুষের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
শুভেচ্ছা বক্তব্যের বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী সময় অহিদুর রহমান বহুত্ববাদী সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি কেন্দ্রটি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বলতে গিয়ে বলেন, ‘কলমাকান্দা উপজেলা প্রতিবেশীয় অঞ্চলের দিকে দিয়ে যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি আবার জাতিগোষ্ঠীগত, পেশাগত, ধর্মীয় বিশ্বাসগত ভাবেও বৈচিত্র্যতাকে ধারণ করে। যেমন এই উপজেলায় সমতলভূমি আছে আবার আছে পাহাড়ি অঞ্চল আরো আছে হাওরাঞ্চল। আবার এ উপজেলা বিভিন্ন ধর্ম ও পেশার মানুষের সহাবস্থান লক্ষ্যণীয় এখানে বাঙালি, গারো, হাজং, হদি, বানাই প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান দেখা যায়। পারষ্পরিক এই যে সহাবস্থান থেকে যে সুসস্পর্ক গড়ে উঠেছে সেটিকে আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বহুত্ববাদী সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়।’