বৈচিত্র্যময়তার স্বীকৃতি পারে সামাজিক শান্তি বয়ে আনতে
:: রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন ::
বৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের দেশে ভিন্ন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে যেমন রয়েছে তেমনি মানুষের মধ্যেও রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যেমন-পেশা, ভাষা, ধর্ম, বিশ্বাস, বয়স, লিঙ্গ, চিন্তাগতসহ অন্যান্য বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যময়তায় আমাদের দেশকে অনেক বেশি সুন্দর করে তুলেছে। শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো পৃথিবী টিকে আছে এই বৈচিত্র্যময়তার উপর। বৈচিত্র্যময়তার সংস্কৃতি আমাদের পৃথিবীকে জানতে, বুঝতে সহায়তা করে। বৈচিত্র্যময়তা আমাদের একে অন্যের প্রতি পারস্পারিক যোগাযোগ, নির্ভরশীলতা, সম্পর্ক তৈরিতে সহায়তা করে। তাই আমরা যদি বাসযোগ্য পৃথিবী ও দেশ গড়তে চাই তবে বৈচিত্র্যময়তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে, সম্মান করতে হবে এবং সেই সাথে যাতে বৈচিত্র্য টিকে থাকে সেই জন্য বৈচিত্র্য রক্ষার্থে কাজ করতে হবে। জননেতৃত্বে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বারসিকও আগামী দিনে জনমানুষের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের স্বার্থে বৈচিত্র্যকে উন্নয়নের মূলমন্ত্র হিসেবে পথচলা শুরু করেছে। যার মূল উদ্দেশ্য হলো বৈচিত্র্যকে রক্ষা করা, বৈচিত্র্যকে সম্মান করা, বৈচিত্র্যকে আপন গতিতে চলতে দেওয়া, বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি ও সম্মান দেয়া। এ বৈচিত্র্য মানুষে মানুষে, উদ্ভিদে, প্রাণীতে এবং অন্যান্য সৃষ্টিতে। মানুষের মধ্যকার বৈচিত্র্যকে সম্মান করার সেই প্রত্যয় থেকেই বারসিক আদিবাসী তরুণী হেলেনা বিশ্বাসকে তাঁর অর্জনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, উৎসাহিত করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী সদরের ভূগরইল গ্রামের হেলেনা বিশ্বাস ক্যারাতে প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক অর্জনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে গৌরবময় পদ অর্জন করেছে।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন থেকে ১১ কি. মি পশ্চিমে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের ভূগরইল গ্রাম। ভূগরইল গ্রামের একটি পাড়া আদিবাসী খ্রিস্টান পাড়া। যারা পূর্বে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮০ সালের দিকে খ্রিস্টান ধর্মে দিক্ষীত হয়ে এখানে বসতি শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে পরিবারের সংখ্যা ৭টি হলেও বর্তমানে মোট পরিবারের সংখ্যা ৫৫টি। ৫৫টি পরিবারের হেলেনা বিশ্বাসের পরিবার একটি। পরিবারের মোট সদস্য ৬ জন; মা, বাবা ছোট তিন ভাই ও বোন। তার বাবা নিখিল বিশ্বাস একজন দিনমজুর, মা ক্লেমেন্তিনা বিশ্বাস গৃহিনী। তিন ভাই পড়াশেনা করে। হেলেনা বিশ্বাস (১৮) ভূগরইল খ্রিস্টান পাড়ায় অবস্থিত সাধু ডন বক্স প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। এরপর নওদাপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করা অবস্থায় একদিন তাদের গ্রামে ইডন ড্রাগন মার্সালাটের শিক্ষক মো. শরিফুল ইসলাম সাগর ক্যারাতে শেখাতে আসে। ক্যারাতে শেখানোর স্থান ঠিক হয় সাধু ডন বক্স প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রথম পর্যায়ে তাদের পাড়ার মোট ১০জন ছেলে ক্যারাতে শিখতে আসে। ছেলেদের সেই ক্যারাতে শেখা দেখে হেলেনার এই খেলা শিখতে ইচ্ছে হয় এবং তার মনে হয় সে এই খেলা সে ভালোভাবে খেলতে পারবে। তার কিছুদিন পর সেও এই খেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রথমে একমাস পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর এক কি.মি দূরে মহানগর কলেজে চর্চা শুরু করে। মনের ইচ্ছে ও নিয়মিত চর্চার ফলে সে এই খেলায় ভালো করতে থাকে এবং শিক্ষকের প্রশংসা অর্জন করে। একবছর চর্চার পর ২০১৩ সালে ক্যারাতে প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্চ পদক অর্জন করে। ব্রোঞ্চ পদক অর্জনের পর তার নাম সেনাবাহিনীতে তালিকা ভুক্ত হয় এবং ২০১৪ সালেই হেলেনা সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে নিযুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করে। প্রাথমিক অবস্থায় সেই বছর প্রশিক্ষণ এর জন্য খুলনা গিলাতলা ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয় এবং ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে তার প্রশিক্ষণ শেষ হয়। বর্তমানে হেলেনাকে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর করা হয়। হেলেনা বলেন, “আমার সাফল্যের পেছনে আমার মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।”
হেলেনা বিশ্বাসের মা ক্লেমেন্তিনা বিশ্বাস বলেন, “প্রথমে যখন খুলনাতে চাকুরি পায় তখন আমি আর এর বাবা রাজি ছিলাম না পরে মেয়ের মন খারাপ দেখে রাজি হই। তবে এখন মনে করি আমরা সেই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আজ আমার মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। আজ সবাই আমার মেয়ের প্রশংসা করে। আজ সবাই আমাদের বাসায় আমার মেয়ের সফলতার গল্প শুনতে আসে।” তিনি আরো বলেন, “আমার ইচ্ছে ছিল আমার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবারে ছেলে মেয়েকে ভেদাভেদ করা উচিত নয়। কারণ ছেলে হোক আর মেয়েই হোক সবাই পারে জীবনে সফলতা অর্জন করতে। আমি চাই আমার মেয়েকে দেখে আরো অনেক মেয়ে সফল হোক এবং পরিবারে বাবা মা যেন ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কোন বৈষম্য না করে।”
আদিবাসীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে তবে এই সফলতার গল্পই ভবিষ্যতে আদিবাসীদের সর্বস্তরে স্বীকৃতি, সম্মান, শ্রদ্ধা পাওয়ার ইতিবাচক দিক হিসেবে প্রমাণ করে। বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় পেশায় নিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতির মনোভাব, মূল্যবোধের যেমন পরিবর্তন হবে তেমনি সামাজিক সহিংসতা, অন্যায়, দ্বন্দ দূরীভূত হয়ে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। হেলেনা বিশ্বাস সেই পথের সূচনারই একজন অগ্রপথিক। যাকে দেখে ভবিষ্যতে আরো অনেক সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। হেলেনা প্রমাণ করেছে এই পৃথিবীতে ভাষাগত, জাতিগত, সংস্কৃতিগত, লিঙ্গগত বিভেদে মানুষের উন্নয়ন হয় না বরং এই বৈচিত্র্যময়তার স্বীকৃতি পারে সকলের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে।