আগাম বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি বালিতে বিপর্যস্ত সীমান্ত এলাকার জনজীবন

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। তবে দেশের অধিকাংশ নদী এখন মৃতপ্রায়। কোন কোন নদী মুছে গেছে বাংলার মানচিত্র থেকেও। বাংলাদেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে সাতটি জেলা ভাটি এলাকা নামে চিহ্নিত। এই সাতটি জেলা হলো-কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোণা। এই সাতটি জেলায় মোট ৪২১টি হাওর রয়েছে বিধায় এগুলোকে হাওরাঞ্চল বলা হয়। যেসব নিচু এলাকা বর্ষায় জলে ভরে যায় এবং হেমন্তে শুকিয়ে যায় সেসব নিচু এলাকাই হল হাওর। হাওরের যে অংশে হেমন্তকালেও পানি থাকে তাকে বলা হয় বিল। হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ জমিই এক ফসলী এবং একমাত্র ফসল হলো বোরো ধান। আমন জমির পরিমাণ খুবই কম। বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের উপরই এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল। ধান বিক্রির টাকায় চলের পরিবারের সদস্যদের সারাবছরের খোরাক, সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র ইত্যাদির খরচ। প্রাকৃতিক কারণে কোন বছর ধান গোলায় তুলতে না পারলে অনাহার, অর্ধাহার ও ধার-দেনায় দিন কাটে এ অঞ্চলের মানুষের। আবার এক বছর ঠিকমত ধান ঘরে তুলতে পারলে কোন রকম ধার-দেনা না করেই দু’বছর কাটিয়ে দিতে পারে এ অঞ্চলের কৃষকরা। কিন্তু প্রকৃতি ভাটি অঞ্চলের মানুষদের জন্য এই সুখ প্রতিবছর বরাদ্দ রাখেনা। অতিবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছরই হাওরাঞ্চলের কৃষকরা কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতিবেশি দেশ ভারত তাদের সীমান্ত ঘেঁষে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সীমান্তের নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পাহাড় কাটা এবং অপরিকল্পিত ও অপরিবেশবান্ধব উপায়ে কয়লা, পাথর ও চুন উত্তোলন করার ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। প্রকৃতির বিনাশ করে ভারতের এই উন্নয়ন কর্মকান্ডের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ভাটি এলাকার ও সীমান্ত এলাকার কৃষি, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্যের উপর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাওরাঞ্চল ও সীমান্ত এলাকার কৃষকরা।
waste-of-tekerghat-bazaar-by-sand
বিভিন্ন সূত্র মতে, ১৭৮৭ সালে বন্যার পর ব্রহ্মপুত্র নদের গতি পরিবর্তন এবং ডাউকি স্তরচ্যুতির ফলে এ অঞ্চলের মাটির স্তর তিন থেকে ১০ মিটার দেবে যায়। সৃষ্টি হয় ৪২১টি ছোট বড় হাওরের। সূত্র মতে, এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ১৩৭টি, কিশোরগঞ্জে ১২১টি, নেত্রকোণায় ৭০টি, সিলেটে ৪৫টি, হবিগঞ্জে ৩৯টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬টি ও মৌলভীবাজারে ৩টি। বর্ষায় এসব অঞ্চল সম্পূর্ণ প্লাবিত হয় এবং মানুষ চার থেকে পাঁচ মাস পানি বন্দি থাকে। সীমান্তের ওপারে ভারতে ভারি বৃষ্টিপাত হলে সৃষ্টি হয় পাহাড়ি ঢলের। দশ-পনের বছর আগেও পাহাড়ি ঢল ভাটি এলাকার কৃষিজমির জন্য আর্শিবাদ বয়ে আনত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবত পাহাড়ি ঢল সীমান্ত এলাকা ও ভাটি এলাকার কৃষকদের দুঃখ হয়ে দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভাটি এলাকার ফসলী জমি ও বাড়িঘর ভেসে যায়। পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি প্রতিবছরই কয়েক দফায় ভাটি অঞ্চলের মানুষ বন্যার সন্মূখীন হয়। প্রথম দফায় আগাম বন্যা হয় এপ্রিল মাসে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় বন্যা হয় মে থেকে আগস্ট মাসে। এপ্রিল মাসে সমস্ত ভাটি অঞ্চলের ধান পেকে যায় এবং কৃষকরা ধান ঘরে তোলেন। তাই আগাম বন্যায় ভাটি অঞ্চলের কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। হাওর এলাকায় সবচেয়ে বেশি বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধান চাষ হয়। বিআর-২৮ ধান সবার আগে পাকে এবং বিআর-২৯ পাকে ২০-২৫ দিন পর। হাওরের হাজার হাজার একর জমির ধান এক সাথে পাকার ফলে বোরো ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিকের প্রকট সংকট দেখা দেয়। সঠিক সময়ে ধান কেটে ঘরে আনতে দেরি হলেই আগাম বন্যা পেয়ে বসে। প্রতিবছরই অনেক কৃষক তাদের কষ্টার্জিত একমাত্র বোরো ধান আগাম বন্যা ও শ্রমিক সংকটের জন্য সময়মত ঘরে তুলতে পারেন না।
rajai
বোরো ২০১৫-২০১৬ মৌসুমেও আগাম বন্যায় নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের শতাধিক বিঘা জমির ধান পাক ধরার শুরুতেই পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকরা বেশির ভাগ সময়েই একতৃতীয়াংশ ধান শ্রমিকদের দেওয়ার চুক্তিতে জমি থেকে ধান কেটে ঘরে তোলেন। অন্যদিকে ঘরে তোলা ও সংরক্ষণের অভাবে কৃষকরা কাঁচা অবস্থায় মাঠ থেকেই নামমাত্র মূল্যে (৪০০/৪৫০টাকা মণ) বেশির ভাগ ধান বিত্রি করে দেয়। আগাম বন্যা এখন হাওরাঞ্চলের প্রতিবছরের নিয়মিত ঘটনা। হাওরবাসী ও পাহাড়ি সীমান্তবাসীদের মতে, ভারত সরকার ভারতের সীমান্ত এলাকায় সড়ক নির্মাণ, বিএসএফ ক্যাম্প তৈরির জন্য ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ধ্বংস করে এবং কয়লা ও চুনা পাথর অপরিকল্পিত ও অপরিবেশ সম্মত উপায়ে উত্তোলন করাতে প্রতিবছর কোয়ারির বালি ও পাথর পাহাড়ি ঢলের সাথে ভেসে এসে ছোট ছোট পাহাড়ি ছড়াগুলো ও হাওরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বালিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি নদী ও ছড়ার দূর্বল বাঁধ ভেঙ্গে শত শত একর কৃষিজমি বালি পড়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এসব পাহাড়ি ছড়া ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু ঢল হলেই পানি অতিপ্রবাহিত হয়ে ফসলী জমি বালিতে সয়লাব হয়ে পড়ছে।

মূল হাওরের কৃষি জমিগুলো পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ধীর গতিতে ভরাট হলেও পাহাড়ি সীমান্তঘেঁষা কৃষি জমিগুলো ভরাট হচ্ছে খুবই দ্রুত গতিতে। কৃষি জমিতে বালি পড়ায় জমিগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। কৃষি জমিতে বালি পড়ার এই গতিকে জ্যামিতিক গতি বললেও কম বলা হবে। কারণ প্রতিবছরই একরের পর একর জমি চাষের অনুপযোগি হয়ে পড়ছে। আগাম বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি বালি তাই এখন সীমান্ত এলাকা ও হাওরবাসীদের দুঃখ হয়ে স্থায়ীভাবে দেখা দিয়েছে। প্রতিবেশি দেশের সীমান্ত আকাশে মেঘ হলেই সীমান্ত ও হাওরাঞ্চলের অধিবাসী কৃষকরা এখন হাই-হুতাশ করতে থাকেন এই ভেবে যে, এই বুঝি ঢল নামবে, তলিয়ে যাবে ক্ষেতের সমস্ত ফসল পানি ও বালির নিচে। হাওরাঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ নদী এখন পলি পড়ে এবং পাহাড়ি  ছড়াগুলো বালিতে ভরাট হয়ে গেছে। পাহাড়ি ঢলের ফলে প্রতিবছর নদীগুলোতে দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত পলি ও বালি পড়ছে। বর্তমানে সুরমা নদীসহ সীমান্ত অঞ্চলের অধিকাংশ নদীর নাব্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌছেছে। নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের কালাপানি, তাড়ানগর, চৈতানগর, রামপুর, গোড়াগাও, চেংনি, রংছাতি ইউনিয়নের বাঘবেড়, চন্দ্রডিঙ্গা, চৈতা, সন্যাসীপাড়া, সিংকাটা, হাতিবেড়, বেতগড়া, সুনামগঞ্জ জেলার বাঙ্গালভিটা, টেকেরঘাট, বড়ছড়া, কলাগাও, চাঁনপুর, রাজাই, কড়ইগড়া গ্রাম বিভিন্ন পাহাড়ী নদী ও ছড়া বালিতে ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে সামান্য পাহাড়ি ঢল হলেই ওপার থেকে ভেসে আসা বালিতে কৃষি জমি ও বসতভিটে ভরে গিয়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
bsf-camp-boarder-road-constructing
সাম্প্রতিক সময়ে বালিতে ক্ষতিগ্রস্ত সীমান্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে কৃষিজমি ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে আমার দেখা ঐসব এলাকার কৃষিজমি, বাজার ও বসতঘরগুলোর সাথে সাম্প্রতিক সময়ের দেখা চিত্রের বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। এলাকার অবস্থা দেখে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল পাইপ দিয়ে বালি ফেলে হয়তো জমি ভরাট করা হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারি বালি ফেলা হয়নি বরং ভরাট হয়েছে। বালির ফলে ওই সমস্ত এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তেমনি প্রাণবৈচিত্র্যও বিলুপ্তির পথে। গৃহপালিত পশু-পাখির খাবারেও সংকট দেখা দিয়েছে। জমি চাষ করতে না পারায় জমির মালিকরা কৃষি পেশা ছেড়ে অন্যান্য পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু যেসব কৃষক কৃষি পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হতে পারছেন না তারা অনন্যোপায় হয়ে দু’মুঠো দু’বেলা খেয়ে পূর্ব পুরুষদের পেশাকেই আকড়ে পড়ে আছেন।
india-road-constructing-near-of-tekerghat
সীমান্ত এলাকার কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে ছোট পরিসরে ছড়ার পাড়ে সাময়িক বাঁধ দিয়ে পাহাড়ি ঢল ও বালি থেকে কৃষিজমি ও ফসল রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারিভাবে ছড়া ও নদীর বাঁধ তৈরির জন্য এলাকাবাসী স্থানীয় সরকারের (ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সাংসদ সদস্য) সহযোগিতার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। কিন্তু এর প্রতিকারে সরকারিভাবে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার অধিবাসী এন্ড্রো সলমার বলেন, “৮/১০ বছর আগে থেকেই আমি এ বিষয়ে বিভিন্ন সরকারি বিভাগকে অবহিত করেছি কিন্তু কোন ফল হয়নি। বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রচার হলেও (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স) সরকার কোন গুরুত্ব দেয়নি। ৮/১০ বছর আগে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হলে পাহাড়ি বালি থেকে সীমান্ত এলাকার মানুষের বসতঘর ও কৃষিজমি রক্ষা পেতো।” তিনি আরও বলেন, “এখনও যদি সরকার আন্তঃদেশীয় সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে হয়তো সীমান্ত এলাকা ও হাওরাঞ্চলের হাজার হাজার একর কৃষিজমি বালি ভরাট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।” সীমান্ত অঞ্চলের কৃষকরা ইতিমধ্যে তারা চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যের সুপারিশসহ আবেদন কলমাকান্দা পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দিয়েছেন। কলমাকান্দা সংসদ সদস্য তার উন্নয়ন তহবিল থেকে সাময়িক সহায়তা হিসেবে বাঁধ নিমার্ণের (আইল) জন্য কিছু টাকাও দিয়েছেন।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশী কৃষকদের বসতবাড়ি ও কৃষিজমি পাহাড়ি ঢল ও বালি ভরাটের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পাহাড় কেটে সীমান্তে ভারতের সড়ক ও বিএসএফ এর ক্যাম্প তৈরির মত উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধে (বাংলাদেশের কৃষি, জলাভূমি ও পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা নিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হাওরাঞ্চল মুছে যাবে চিরতরে। হারিয়ে যাবে হাওরাঞ্চলের সমৃদ্ধশালী প্রাণবৈচিত্র্য, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে হাওরের জন জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও পরিবেশ হারিয়ে ফেলবে তার ভারসাম্য, নেমে আসবে সীমাহীন দুর্যোগ; যে দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে আর কখনো সম্ভবপর নাও হতে পারে!

happy wheels 2