দুর্যোগে বিপর্যস্ত উপকূলের জীবন-জীবিকা
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ। যার আঘাতে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গত ২৭ মে ২০২১ তারিখে ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ এর তান্ডবে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসরত পেশাজীবী জগোষ্ঠীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। যে ক্ষতির কারণে জীবন ও জীবিকার প্রতিটি স্তরে দেখা দেয় নানা ধরনের প্রভাব। ঘূর্ণিঝড় ইয়াশে বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তার সম্ভাব্য ও প্রাথমিক একটি চিত্র তুলে ধরা হল।
বাস্তুভিটা বিচ্ছিন্ন প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর জনগোষ্ঠীর এক পূনবার্সন কেন্দ্র উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের আশ্রয়ন প্রকল্প। এটি স্থানীয়ভাবে ব্যারাক নামে পরিচিত। আইলার পর ব্যারাকে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৩০টি জেলে, ২০টি আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়, ২০টি প্রান্তিক হিন্দু ও ৩০টি কাহার-মুসলিম পরিবারকে পূনবার্সন করা হয়। বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্প ব্যারাক-এ অবস্থানরত এ সকল পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এবং খাদ্য চাহিদা নিরসনে পুষ্টিমান বজায় রাখতে জৈব বালাইনাশক ও জৈব সার প্রয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এলাকা উপযোগী সবজি উৎপাদন বীজ সংরক্ষণ ও স্থায়িত্বশীল কৃষির জন্য বেসরকারী গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বারসিক কাজ শুরু করার প্রাক্কালে এখানের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ মরুভূমির মত। কেননা তৎসময়ে এখানে কোন সবজি না সবুজ বৃক্ষ ছিল না। পর্যায়ক্রমে তারা কৃষি কাজ শুরু করে মৌসুমভিত্তিক নানা জাতের সবজি উৎপাদন ও কৃষিকাজ অব্যাহত রেখেছে। বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পের পেশাজীবী মানুষেরা নিজেদের পরিশ্রমে ব্যারাক-কে সবুজ প্রান্তরে পরিণত করেছিল। কিন্তু বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও আম্পানের ক্ষত শুকিয়ে না যেতেই আবারো আঘাত হাতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ। এরই মাঝে চলতে থাকে করোনার চরম প্রার্দুভাব। সব মিলিয়ে বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ণ প্রকল্পের মানুষের জীবন-জীবিকা একবারে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে এখানে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষেরা নানা ধরনের ভোগান্তি ও কষ্টের মধ্যে জীবন পার করছেন। তারই মাঝখানে হঠাৎ করেই আঘাত হানে ইয়াশ।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াশের তান্ডবে বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ণ প্রকল্পের পশ্চিম পাশের চুনা নদীর ওয়াপদা রাস্তা আংশিক ভেঙে ও রাস্তা ছাপিয়ে জোয়ারের লোনা পানি ভিতরে প্রবেশ করে। যার ফলে ক্ষেতের ফসল ও পুকুরের মাছসহ নানা ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হয়। ব্যারাকের অভ্যন্তরে ৪টি বড় ধরনের স্বাদু পানির পুকুর রয়েছে। তার মধ্যে জেলে বেডের পুকুরটির মাছ ধরে শুকিয়ে রেখেছিল বাকি ৩টি পুকুরে স্বাদু পানির মাছ রুই, মৃগেল, কাতলা, কালবাউশ, পারশে, টেংরা, ভাঙাল, তেলাপিয়া, গলদা সহ নানা প্রজাতির মাছ ছিল। ৩টি পুকরের সব মাছ মিলিয়ে আনুমানিক ৩ লাখ হবে বলে জানালেন ব্যারাকের স্থানীয় মানুষেরা। লবণ পানি প্রবেশের কিছু সময় পরে সব মাছ মারা যায়। ওল, কচুরমুখি, বেগুণ, ঢেড়স, ঝিঙা কুশি সহ নানা জাতের ফসল লবণ পানিতে তলিয়ে বর্ষাকালীন সবজির ফসল ও বীজ সব বিনষ্ট হয়। চারপাশের রাস্তা ব্যাপক আকারে ধসে ভেঙে যায়। নিজেদের পুকুরের টাকায় অভ্যন্তরে তৈরিকৃত চলাচলের ছোট ইটের রান্তা, উঠান, চুলা, বাথরুম, হাঁস-মুরগির ঘর সহ ফলজ বৃক্ষ কুল, তেঁতুল, আমলকি, গবেদা, ডালিম, কাঁঠাল, পেঁপে বনজ বৃক্ষ হিসেবে নিম, রেইনট্রি, খদি, বাবলা, আকাশমনি মেহগনি, সাই বাবলা, সেজি, ঔষধি হিসেবে হেন্না, থানকুনি, হেলাঞ্চ, কলমি, খুদকুড়ি, গাদমনি, গিমেশাক, নোনা গড়গড়েসহ সবকিছু পানিতে ডুবে যায়। কিছু গাছ মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিছু কিছু গাছ মরে যেতে পারে বলেই ধারণা করছেন তারা। তাদের রাস্তার পাশ দিয়ে যে নেটে ঘেরা ছিল সেটি ও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামনে বর্ষা মৌসুম এই মুহুর্তে পুকুরের লবণ পানি সেচ দিয়ে বের করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে চায় তারা। তাছাড়া রাস্তাগুলো অতিদ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে বর্ষায় আবারো চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে বলে জানালেন ব্যারাকের সভাপতি রুহিতদাস সরদার। তারা ১০০ ঘরের সবাই মিলে আবোরো ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যারাক টিকে সবুজায়ন ও কৃষি সমৃদ্ধ করবেন বলে তিনি জানান। ইতোমধ্যে তারা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডলের সাথে যোগাযোগ করলে এই মুহুত্বে তারা মূল নদী ভাঙনে ব্যস্ত বলেই তিনি জানান এবং পরবর্তীতে কি করা যায় সেটি বিবেচনা করবেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা, জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন এ উপজেলার মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী। এগুলো মোকাবেলা করেই জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয় সকলের। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পের পেশাজীবী জনগোষ্ঠী ইয়াশ এর মত দুর্যোগ এর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন