বরেন্দ্র অঞ্চলে চন্দ্ররোড়া সাপের উপদ্রব এবং করণীয়
রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে বিগত একবছরেই চন্দ্রবোরা (রাসেল’স ভাইপার) সাপের কামড়ে ১৫ জন মানুষ মারা গেছেন। প্রাকৃতিক লীলাভূমি এবং ঘনজঙ্গলে আচ্ছাদিত, লাল মাটির উচু-নীচু বির্স্তীন মাঠ আর খাল খাড়ির, নদী-নালা, প্রাকৃতিক জলাধারের বৈশিষ্ট্যে ভরপুর ছিলো এই বরেন্দ্র অঞ্চল। নানা প্রাণের বৈচিত্র্য আর আন্তঃসম্পর্কের ভিতও ছিলো অটুট। কিন্তু দিনে দিনে নানামুখী কারণেই বৈচিত্র্যতা এবং আন্তঃ সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সংঘাত। ফলে মানুষসহ ও অন্যান্য প্রাণী ও প্রাণের মধ্যেও তৈরি হয়েছে দুরত্ব; অবিশ্বাস ও শত্রুতা। এই কারণে চন্দ্রবোড়া (রাসেল’স ভাইপার) সাপ আজ যেমন হয়েছে মানুষের শত্রু ঠিক তেমনি মানুষও হয়েছে ওই সাপের শত্রু। মূলত প্রকৃতির আন্ত নির্ভরশীলতার ছন্দতা বিঘিœত করে মানুষই ডেকে আনছেন এই সংকট। বরেন্দ্র অঞ্চলের বর্তমান ভয়াবহ এই সমস্যা নিয়ে জনমানুষের সাথে প্রত্যক্ষ আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণের আলোকেই এ লেখাটি তৈরি করেছেন মো. শহিদুল ইসলাম।
ভূমিকা
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত রহস্যে ঘেরা বরেন্দ্র অঞ্চল। মাটির রঙ লাল এবং অঞ্চলটি বাংলাদেশের তথা সমুদ্র উপকূল থেকে অনেক উচু হওয়াতে এখানে কদাচিৎ বন্যা হয়। প্রবীণজনের মতে, বরেন্দ্র অঞ্চলে এমন কিছু এলাকা আছে যেখানে সৃষ্টির পর থেকেই কখনো বন্যার পানিই উঠেনি। প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক কারণেই এখানকার বৈচিত্র্য দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। কিন্তু উন্নয়ন ভাবনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ভিন্নতা ও স্বকীয়তা যুক্ত হয়নি। ফলশ্রুতিতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতই এই অঞ্চলে দেখা দিয়েছেন উন্নয়ন দুর্যোগ। কখনো পানির জন্যে হাহাকার আবার কখনও প্রাকৃতিক বন জঙ্গল নিধন করে তৈরি করা হয়েছে নানান সমস্যা ও সঙ্কট কখনওবা বিশেষ বৈশিষ্ট উঁচু-নীচু কৃষি জমি কেটে সমান করা হয়েছে নষ্ট করা হয়েছে প্রাকৃতিক বিন্যাস। চলমান সময়ে তেমন একটি জনসংকট বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষদের আতংকিত করে তুলছে, বরাবরের মতোই এবারও তার ভুক্তভোগী গ্রামের সেই গরিব কৃষকরাই। বরেন্দ্র অঞ্চলের এলাকা গোদাগাড়ি, নাচোল এবং তানোর উপজেলাসহ এর আশপাশের উপজেলায় আতংক ছড়াচ্ছে রাসেল’স ভাইপার নামটি। নামটি কিছু মহলে বিশ্বখ্যাত হলেও স্থানীয় বরেন্দ্রবাসীর কাছে একেবারেই নতুন, তাই আতংক ছড়াচ্ছে বাতাসের বেগে। রাসেল’স ভাইপারকে যখন জানতে পারে এটি চন্দ্রবোড়া তখন আতংকের হিমাঙ্ক ১০০ ডিগ্রী থেকে চলে আসে ৫০ ডিগ্রীতে। কারণ রাসেল ভাইপার নামে যে সাপটি মিডিয়া জগতে তুলকালাম তুলেছে তা আদতে এ অঞ্চলের প্রবীণ এবং অভিজ্ঞজনের কাছে চন্দ্রবোড়া হিসেবে পরিচিত। চন্দ্রবোড়া একটি সাপের জাত, এই সাপ এই অঞ্চলের যুগ-যুগান্তের বাসিন্দা। একসময় মানুষ, পশু পাখি এবং চন্দ্রবোড়া সবাই মিলে এই অঞ্চলে সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। কিন্তু এখন একে অপরের শত্রু হয়ে প্রতিনিয়ত ভয়ংকর থেকে অতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। চন্দ্রবোড়া মেরে ফেলছে মানুষকে আবার মানুষও মেরে ফেলছে চন্দ্রবোড়াকে। আতংক ছড়িয়ে পড়ছে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। বাড়ছে নানা ধরনের ভুল বোঝাবুঝি। গত ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাসেল’স ভাইপার সাপ বিষয়ে সংকট বেড়েই চলেছে। তাই স্থানীয় প্রবীণ এবং সচেতন মহলের পরামর্শে বারসিক নিউজ ডটকম এর উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে রাসেল’স ভাইপার এবং স্থানীয় জনতার মতামত জানতে, রাসেল’স ভাইপারের উপদ্রুত এলাকায় বিগত দিনগুলোতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। রাসেল’স ভাইপার বেশি দেখা গেছে এবং বেশি জীবন হানি হয়েছে এমন এলাকা যেমন রাজশাহীর তানোর উপজেলার শিবরামপুর, জুমার পাড়া, তেলো পাড়া, সাইধাড়া, মাড়িয়া, জোকারপাড়া, চাপড়া, ইত্যাদিসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার খড়িবোনা, পাইকুড়া, নূরপুর, জোরপুকুর, রায়পাড়া, নন্দিঘর, টগরইল সাওতাল পাড়া, বরেন্দা গ্রামের নানা বয়সের মানুষের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষাৎকার ও মতামত গ্রহণ করা হয়। মূলত সংগৃহীত তথ্য এবং এলাকার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে এলাকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপবৈচিত্র্য এবং চন্দ্রবোড়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপবৈচিত্র্য এবং সাপের ধরন নিয়ে কথা বলতে রাজশাহীর তানোর উপজেলার সাপ বিশেষজ্ঞ শ্রী প্রণব কুমার সরকার (৬২) বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে আমার মতে একসময় প্রায় ৮০ ধরনের সাপ ছিলো। এখনো সব সাপই আছে তবে কিছু জাতের সাপ ভীষণভাবে কমে গেছে। এর মধ্যে বিষাক্ত সাপের মধ্যে ৬টি সাপ দেখতে পাওয়া যায় যথা: ১. চন্দ্রবোড়া (রাসেল’স ভাইপার), ২. গোখড়া (গোমা), ৩. কোবরা (আলাদ), ৪. কেউটে ৫. বাঁশবোড়া (সবুজ সাপ) ৬. সামুিদ্রক (পানি সাপ)।” তিনি বলেন, “১৯৮৫ সালে চন্দ্রবোড়া সাপটি খুব কম সংখ্যক দেখা যেতো। অনেকবছর পর তানোরের জুমার পাড়া-শিবরামপুরে ১৯৯৫ সালে সাপটি দেখতে দেখা যায়। সেখানে সাপটি একজন আদিবাসী নারীকে দংশন করেছিলো, ভুল চিকিৎসার কারণে তিনি মারা যান। লোকজন সাপটিকেও মেরে ফেলেন।” তিনি জানান আদিকাল থেকে সাপটিকে স্থানীয় মানুষ চন্দ্রবোড়া বলেই জানতো। তিনি বলেন, “চন্দ্রবোড়া সাপ কামড় দিলে বা দংশন করলে দংশিত স্থানের ধরন দেখলেই বোঝা যায় এটি চন্দ্রবোড়া সাপে দংশন করেছে কি না। কারণ- চন্দ্রবোড়া সাপ দংশন করলে দংশিত স্থান ব্লেড দিয়ে কাটার মত হয়। এর দাঁত বেশি লম্বা ও ধারালো হওয়ায় দংশনের সময় ব্লেডের মত কেটে যায়। তাই দংশনের স্থান দেখলেই বোঝা যাবে এটি চন্দ্রবোড়া নাকি অন্য সাপ দংশন করেছে।”
অন্যদিকে নাচোল এলাকার নন্দিঘর গ্রামের হজরত বেলাল (৭৫+) জানান, মাঝে মাঝে এই এলাকায় এই সাপ দেখা যায়। এই সাপের ফনা নাই। খুব দ্রুত চলতে পারে না। ২০১৩ সালে চাপাই নবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দা গ্রামে চন্দ্রবোড়ার দংশনে আনোয়ার হোসেন (১৮) নামে একজনের মৃতু হয়। সেসময় ওই গ্রামের প্রবীণ কবিরাজ ও চিকিৎসক মো. বিরাজ মোল্লা (৮০+) চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত রোগীর শরীরের রক্ত পরীক্ষা (নিজস্ব কৌশলে রক্ত পরীক্ষা) করে দেখেন রোগীর শরিরে কোন ধরনের বিষ নেই । তিনি বলেন, আমি আগে পরীক্ষা করে দেখী কোন ধরনের বিষাক্ত সাপ দংশন করেছে। এর পর সেই অনুযায়ী আমি ঔষধ (এন্টিভেনম) প্রয়োগ করি। আমি অনেক সাপে কাটা রোগীকে ভালো করেছি, কিন্তু সেদিন আমি আনোয়ার হোসেনকে ভালো করতে না পেরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাই। কিন্তু পরে দেখলাম সেখানে গিয়েও আনোয়ার বাঁচতে পারলো না। ৮দিন পর আনোয়ারের শরিরে পচন ধরে মারা যায়।” এর আগে তিনি কখনও এ সাপটি দেখেননি বলে জানান। নাচোলের খড়িবোনা, পাইকুড়া নূরপুর, জোরপুকুর, রায়পাড়া, নন্দিঘর, টগরইল সাওতাল পাড়া, বরেন্দাসহ তানোর উপজেলার দুবইল, পাঁচন্দর, মোহড়, সমাসপুর, গোকুল মথুরা গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রত্যক্ষ তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বেশিরভাগ মানুষেরই এই সাপটি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই; এমনকি বেশিরভাগ লোকই বলেছেন এই সাপটি প্রথমবারের মত দেখা হচ্ছে।
রাজমাহীর গোদাগাড়ী উপডজেলার রাজাবাড়ির আব্দুর রউফ বলেন, “গোদাগাড়ীর নীলবোনা চর, দেওপাড়া, দিয়ানাবোনা এবং পবা উপজেলার গোহমাবোনা গ্রামেও এই সাপ দেখা দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও গোদাগাড়ি উপজেলার নিতলা গ্রামের মৌসুমী ও নাঈমুদ্দিন নামের দুজন এই সাপের দংশনে মারা গেছে। বর্তমান হাসপাতালে চিকিৎসারত আছেন ৩ জন। এক সপ্তাহেই প্রায় ৫টি চন্দ্রবোড়া সাপও মারা হয়েছে। স্থানীয় বেশিরভাগ মানুষের ধারণা এই সাপটি ১৯৯৫ এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় থেকে দেখা যাচ্ছে। সেসময় এদের সংখ্যা একেবারেই কম ছিলো। ইদানীং অনেক বেড়ে গেছে। তাদের মতে, এখন শুধু খাড়ির ধার দিয়েই নয়, বাড়ির আনাচে- কানাচেও পাওয়া যাচ্ছে চন্দ্রবোড়া সাপটি। স্থানীয় শিবরামপুর গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মোঃ ইয়াসিন আলী (৮০+) বলেন, “রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাটি ভারতে পশ্চিমবঙ্গের সাথে লাগানো, শুনেছিলাম সেখানে চন্দবোড়া সাপটি বেশি। হয়তো ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় খাড়ি দিয়ে ভেসে এসেছে এখানে, আর ধীরে ধীরে বংশবিস্তার করে বেশি হয়েছে।”
বিশেষজ্ঞ গণের মতামত-
রাজশাহীর মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু শাহীন’র মতে, এই সাপটি বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত। বিগত ২৫- ৩০ বছরে এই সাপটি দেখা যায়নি, কিন্তু বিগত দুই তিন বছরে এই সাপটি কিছু এলাকায় অনেক বেশি দেখা গেছে। বিগত তিন বছরে চন্দ্রবোড়া সাপটির দংশনে যে রোগীগুলো হাসপাতালে এসেছিলেন তাদের কাউকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সাপটি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় এটির এন্টি ভেনমও ছিলোনা বা এটি নিয়ে তেমন গবেষণাও করা হয়নি এই দেশে। তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত (এপ্রিল, ২০১৬) চন্দ্রবোড়া (রাসেল’স ভাইপার) সাপের দংশিত ১০জন রোগী রামেকে চিকিৎসা নিতে এসেছিলো। এই সাপের দংশিত রোগী বিভিন্ন অ্যান্টি ন্যাক ভেনম দিলে তিনি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। কিন্তু ৩-৪ দিন পর কামড়ের জায়গায় পচন ধরে আর সেটি ধীরে ধীরে সারা শরীরে বিস্তার লাভ করে রোগী ৮-১০ দিনের মধ্যেই মৃত্যু বরন করে।”
ডা. আবু শাহীন আরও জানান, এই বিষধর সাপ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার পর এর কোন ভ্যাকসিন বা ইনজেকশন নেই। সে কারণে রোগীদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, “তিনজনের মৃত্যুর পর আমরা আন্তর্জাতিক বিষ গবেষণা কেন্দ্রে (জার্মান) সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান থেকে একটি গবেষণা টিম গত বছর (২০১৪) তানোরের শিবরামপুর গ্রামের মাঠে মাঠে গিয়ে সেই বিষধর সাপ ধরে এনেছেন। এ সাপের নমূনা সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞ দল পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন।” তিনি জানান, বর্তমান এই সাপের এন্টিভেনম রামেক হাসপাতালে আছে। রোগীকে যতোদ্রুত হাসপাতালে আনা হবে ততো জীবন নিশ্চিত হবে। এই সাপে কাপড় দিলে প্রতি মিনিটে ১% হারে কিডনি ড্যামেজ হতে থাকে। তাই দ্রুতযানে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। রাসেল ভাইপার সাপ বছরে দু’বার বাচ্চা দেয় একসঙ্গে ২০ থেকে ৩০টি। আর লম্বা হয় ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত। সাপটির হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “হয়তো সাপটির প্রিয় খাবারের যোগান পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে আর সে কারণেই প্রজনন বেশি হচ্ছে। এছাড়া বনজঙ্গল একেবারেই কমে যাওয়াতে সাপটি ধানী জমিসহ মাঠেই বিচরণ করার কারণে বেশি দেখা যাচ্ছে।”
তানোর সাািহত্য পরিষদের কবি ও সাংবাদিক অসীম কুমার সরকার বলেন, “রাসেল’স ভাইপার বলেই এই সাপ অনেকের কাছে নতুন মনে হয়। কিন্তু যখন সেটি চন্দ্রবোড়া নামে বলা হয় তখন সেই সাপকে সবাই চিনেন। নাম বিভ্রাট বা নতুন নামে স্থানীয় সাপটির নামকরণে মিডিয়া পাবলিসিটি হওয়ার কারণে আতংকটা আরো বেশিী হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা অনেক পুরাতন সাহিত্য ইতিহাসে চন্দ্রবোড়া সাপের অস্তিত্ব পাই, যেমন হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন উপন্যাসেও আমরা এই সাপের কথা জানতে পারি।”
চন্দ্রবোড়া সাপের দংশনে মৃত্যু
আলোচনা এবং মতবিনিময়কালে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর মাসের দিকে তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউপির সাইধরা গ্রামের পেশায় কৃষক ইয়ামিন কালুর (৫১) পায়ে চন্দ্রবোড়া সাপ দংশন করে। হাসপাতালে নিলে তার মৃত্যু ঘটে। একইভাবে ২০১৪ সালের জুন মাসে নওগাাঁর আগ্রাদ্বিগন গ্রামের জামাল নামের কৃষক, ২০১৩ সালের চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দ্রা গ্রামের আনোয়ার হোসেন (১৮), একই বছরের নভেম্বর মাসে তানোর উপজেলার শিবরামপুর গ্রামের নওশাদ আলীর ছেলে তাজিমুদ্দিন (২৫) এবং ১৯৯৫ সালে জুমার পাড়ার একজন নারীকে সাপটি দংশন করে। ২০১৬ সালে গোদাগাড়ী উপজেলার নিতলা গ্রামের মৌসুমী ও নাইমুল ইসলাম নামে দুজন মারা যায়। এই সাপের দংশনে গত একবছরে বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫ জন মানুষ মারা গেছে (প্রথম আলো,০৪ মে,২০১৬,পৃষ্ঠা ৯)।
চন্দ্রবোড়া সাপের আচার-আচরণ, আহার ও থাকার পরিবেশ
তানোর উপজেলার চাপড়া গ্রামের সাপ বিষয়ে অভিজ্ঞ কবিরাজ ও চিকিৎসক শ্রী প্রণব কুমার সরকার জানান, চন্দ্রবোড়া সাপটি অনেক ধীরে চলে। ধীরে চলার কারণে এটি বেশি দুরে আহার করতে যায় না। আশপাশের এলাকাতেই থাকে এবং আহার করতে বেশি পছন্দ করে। তিনি বলেন, “সাপটি গর্তে থাকতে বেশি পছন্দ করে না। এটি রাতেই বেশি বের হয়, দেখতে অজগড় সাপের মতো। এটি ৩ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। মাথার দিকে অনেক চিকন এবং মাথা ছোট হওয়াতে দ্রুত গতিতে এটি ছোবল মারতে পারে। ধান ক্ষেতে সাপটি ছোট ফড়িংসহ অন্যান্য পোকামাকড় টুপ টুপ করে ছোবল মেরে খায়। সাপটির প্রিয় খাবার ইদুর।” তিনি আরও বলেন, পত্রিকায় দেখলাম সাপটির নাকি প্রিয় খাবার কাঠবিড়ালী! কথাটি একেবারেই সত্য নয়, কারণ সাপটি গাছে ওঠে না, আবার খুব জোরে চলতেও পারে না। এই সাপটি তাই জমিতে এবং আইলের ধারের খাবার সংগ্রহে বেশি ব্যস্ত থাকে। খাবার পেলে এই সাপ কখনো সেখান থেকে বা সেই এলাকা থেকে অন্যখানে সহজে যায় না।” তিনি বলেন, “৮০ সালের দিকে সাপটি উচু নীচু জমির আইলের নীচে চলাফেরা করতে দেখা যেতো। তবে সবখানে নয়। জঙ্গলের আশপাশেই বেশি থাকতে। আগে কিছু দিঘি ছিলো, সেই দিঘিগুলোর চারপাশে বহু জঙ্গল ছিলো, সেই পুকুরগুলোর ধার দিয়ে এই সাপ দেখা যেতো। আমরা ভয়েই সেখানে যেতাম না।” বরেন্দ্র অঞ্চলের আগের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য না থাকার কারণেই এই সাপটি বেশি দেখা দিয়েছে। আগে ইঁদুর থাকতো বনে ভাদারে তা খেয়ে সাপটি বনে জঙ্গলেই থাকতো, কিন্তু ঈদুর এখন বাড়িতে আসায় সাপটিও বাড়ির দিকে আসা শুরু করেছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। নাচোল উপজেলার বরেন্দা গ্রামের সাপে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা দেওয়া প্রবীণ কবিরাজ মো: বিরাজ মোল্লা (৮০+) জানান, চন্দ্রবোড়া পানিতে থাকতে পারে না। জোরে চলতেও পারেনা। খুব বিষধর এই সাপ খুব রাগী হয়। এই সাপ সামনে যাকে পায় তাকে কামড় দেয়। এই সাপ কামড়ালে মানুষ বাঁচে না। এই সাপটি চৈত্র্য-বৈশাখ মাসে বেশি দেখা যায়। এই সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে এবং এত প্রচন্ড বেগে শিকারকে ছোবল মারে যে, পালিয়ে যাওয়ার আর কোন উপায় থাকে না। এদের আবার অনেকগুলো ধরণ রয়েছে যেমন: চন্দ্রবোড়া, আইলবোড়া, কালোবোড়া, বাঁশবোড়া। তিনি বলেন, “এটি শুকনো অঞ্চলে থাকতে বেশি ভালোবাসে। ভেজা মাটিতে বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় এটি থাকে না। উচুঁ শুকনো জঙ্গলে এদের বসবাস বেশি।”
চন্দ্রবোড়া বেড়ে যাবার কারণ
১৯৯৫ সালে চন্দ্রবোড়া সাপটি প্রথম যে এলাকাটিতে দেখা গেছে সেটি হলো তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রাম। সেখানকার নানা বয়সের মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের বেশির ভাগের ধারণা সাপটি ১৯৯৫/১৯৯৮ সালের বন্যার সময় ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে খাড়ি দিয়ে ভেসে এসেছে। শিবরামপুর গ্রামের মো. এনায়েত উল্যাহ (৮০+), মো. ইয়াসিন আলীসহ আরো অনেকে উপরোক্ত ধারণায় বিশ্বাস করেন। সাপ বিশেষজ্ঞ শ্রী প্রণব কুমার সরকারের মতে, চন্দ্রবোড়া আগেও ছিলো এখনো আছে এবং থাকবে। সাপটি বেড়ে যাবার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “হয়তো সাপটির থাকার জায়গা নষ্ট হয়েছে বা খাবার সেখানে না পাবার কারণে খাবারের সন্ধানে এসে মানুষের চোখে পড়ছে।”
সার্বিক পর্যালোচনায় জানা যায়, জঙ্গল বা বন না থাকার কারণে এই সাপটি লোকালয়ে আসছে খাবারের সন্ধানে। আগে এই সাপ বনে জঙ্গলের ইঁদুর এবং ছোট ছোট প্রাণী খেয়ে থাকতো। নিকট অতীতে বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক জমিতে আবাদ না করেই ফেলে রাখতো, ঘাস হতো প্রচুর। সেখানে নানা ধরনের ছোট ছোট পোকামাকড় খেয়ে থাকতো এই সাপ। কিন্তু বর্তমানে এসব বন ও জঙ্গল আবাদী জমিতে পরিণত হওয়ায় সাপগুলো খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে বা ধানক্ষেতে চলে আসে। জমিতে কৃষক কাজ করতে গিয়ে এই সাপের দংশনের শিকার হচ্ছে। সাপটির আহাররত অবস্থায় প্রত্যক্ষ দর্শনকারী শিবরামপুর গ্রামের কৃষক মো. ইয়াসিন আলী (৬২+) বলেন, “এ সাপটি ধানের গাছের নীচ দিয়ে ধীরে ধীরে চলে। ধান গাছের ফড়িংগুলোসহ অন্যান্য পোকা টপ টপ করে ছোবল দিয়ে ধরে খায়। এমনভাবে চিকন মাথা দিয়ে টপ টপ করে ধরে খায় কোন শব্দই হয় না।” তার মতে, ধান গাছের ছোট ছোট পোকাগুলো এই সাপ খেতে পছন্দ করে। এ জন্যে ধান ক্ষেতে বেশি দেখা যায়।
সাপের কামড় এড়াতে বরেন্দ্র অঞ্চলের অভিজ্ঞ এবং প্রবীণদের পরামর্শ
১. সাপ কখনো অযথা মানুষকে দংশন করে না, উত্যক্ত করলে বা সে যদি নিজের জীবনের তাৎক্ষণিক অনিরাপদ মনে করে তাহলেই দংশন করে, তাই সাপের কাছে না যাওয়াই বেশি নিরাপদ
২. প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করা ঠিক না। কারণ এরকম জায়গা পেলে সাপ বসবাস করে সেইসাথে অন্যান্য প্রাণীও বসবাস করে, একে অপরকে খেয়ে জীবনধারণ করে। বসবাসের জায়গা থাকলে বাইরে আসবে না সাপ ।
৩. ঘাসের মধ্যে, ঝোপ ঝাড়ের ভিতর লম্বা বুট জুতা পড়ে পায়ে দিয়ে সাবধানে হাটতে হবে
৪. স্তুপকৃত খড়ি, খড় এবং জমিতে ধান কাটার সময় এবং শস্য ফসলের মাঠে কাজ করার সময় সাবধানে করতে হবে, একটি লাঠি দিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখতে হবে সেখানে সাপ আছে কি না
৫. কাঁশ এবং ছনের জমিতে এবং যেখানে তৃণলতা বেশি সেখানে সাবধানে যেতে হবে কারণ চন্দ্রবোড়া সাপটি এই সমস্ত সমতল তৃণমূল দ্বাড়া আবৃত খোলা জায়গাও বসবাস করে
৬. পাথর বা গুঁড়ি সরানোর সময় এবং এর উপর দিয়ে হাটতে সাবধানে করতে হবে, দেখতে হবে সেখানে কোন সাপ আছে কি না
৭. রাতে হাটার সময় টর্চলাইট বা আলো ব্যবহার করতে হবে। কারণ চন্দ্রবোড়া সাপটিসহ আরো কিছু বিষাক্ত সাপ রাতেই বেশি চলা ফেরা করে।
৮. রাতে শস্যে ফসলের জমিতে ও ফলের বাগানে কিংবা মাছ পাহাড়া দেবার জন্যে মাচা তৈরি করে থাকাই বেশি নিরাপদ অথবা পাশে কার্বলিক এসিড রাখুন যাতে সাপ না আসে
৯. সাপ মারার পর খালি হাতে ধরা যাবে না। কারণ সাপ মরার ভানও করতে পারে বা অসাবধানতা বসত বিষ দাঁতের খোঁচা লাগতে পারে
১০ সজিনার ছাল এবং রসুন থিতু করে ঘরে রাখলে সাপ আসে না।
এই সাপের দংশনে কি করা উচিত
গ্রামের কিছু মানুষের ধারণা-সাপটির দংশন করলে মরণ নিশ্চিৎ। এর কোন চিকিৎসা নেই। কিন্তু চিকিৎসকগণ জানান, এই সাপে কামড়ালে এর চিকিৎসা আছে। রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে আনতে হবে। কবিরাজ ও চিকিৎসক বাবলু সরকার বলেন, “এই সাপ কামড়ালে কোন অপেক্ষা না করে যতো দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এই সাপ কামড়ালে কামড়েরর জায়গায় পচন ধরবে এবং ধীরে ধীরে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে যাবে এবং কিডনী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” সর্পবিশেষজ্ঞ ও তরুণ সর্পখামারী রমন বলেন, “বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ রুক্ষতার কারণে এখানে রাসেল’স ভাইপারের তীব্রতা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি। বেশি রুক্ষতা হলে এই সাপের এই সাপের বিষ বেশি তীব্র হয়। তাই বাইরের এন্ডিভেনম দিয়ে এখানে চিকিৎসা করালে ফলাফল ভালো নাও হতে পারে। এই কারণে চিকিৎসা নেবার পরেও রামেকে রোগী মারা গেছে। অনেক সময় ভালো হয়ে বাড়িতে রোগীকে ছাড়পত্র দেবার পরও বাড়িতে এসে বা আসতেও রোগী মারা গেছে।” তিনি মনে করেন বরেন্দ্র অঞ্চলের রাসেল’স ভাইপারের বিষ দিয়েই এই সাপের এন্টিভেনম তৈরি করতে হবে। এখানকার ডাক্তারদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “যে হারে এই সাপ নিধন করা হচ্ছে তা জীব ও প্রকৃতির জন্যে আরো ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে এই অঞ্চলে। পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। সাপ প্রকৃতি ও পরিবেশের বন্ধু, শক্র নয়। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।”