শিক্ষার আলোকবর্তিকা নিয়ে অন্যকে আলোকিত করেছেন রওশন আরা
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
নেত্রকোণা থেকে মদনপুর যাবার পথে বায়রাউড়া নামক একটি গ্রাম আছে। অনেক বছর আগে পর্যন্ত এই গ্রামের মানুষজন খুব বেশি শিক্ষিত ছিল না। এর কারণ ছিল গ্রাম থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দূরে অবস্থান এবং গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র শ্রেণির। যে কারণে পড়ালেখা বাদ দিয়ে বেশিরভাগ পরিবারের শিশুদের কাজে যুক্ত করে দেয়া হতো। ফলে শিক্ষার আলো তেমনভাবে ছড়াতে পারেনি। হাতে গোনা কয়েকটি সচেতন পরিবারের সন্তানেরাই পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছে। তার মধ্যে রওশন আরা একজন।
কৃষক পরিবারের সন্তান রওশন আরা, তাঁর মায়ের উৎসাহ আর নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় লেখাপড়া শুরু করেন। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৮৪ সালে তিনি এসএসসি পাশ করেন। এ বছরই নার্সিং এ ট্রেনিং এর জন্য ভর্ত্তি হন। কিন্তু দু’ বছরের মাথায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায় পার্শ্ববর্তী গ্রামের সাধারণ কৃষক আ. সাত্তারের সাথে। তাঁর স্বামী তাঁকে আর ট্রেনিং করার অনুমতি দেননি। তাই মাঝপথেই ট্রেনিং ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। তাঁর মায়ের অনেক ইচ্ছা ছিল নার্স হয়ে তিনি অনেকের সেবা করবেন। কিন্তু স্বামীর আপত্তির কারণে সেটা আর করতে পারেননি।
রওশন আরার স্বামী ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। তিনি সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। কাজ তেমন করতেন না। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর দুটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। তখন রওশন আরা ভেবেছিলেন সন্তানের মুখ দেখে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু কিছুই হলোনা। রওশন আরার ভাই মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে রেখে ভাবীও বিয়ে করে অন্য গ্রামে চলে যায়। এতিম দুটি শিশুকে দেখার মতো কেউ ছিলনা। কারণ তাঁর মা ছিলেন বৃদ্ধা। তাই তিনি ভাইয়ের সন্তানদের দেখভাল করার জন্য বায়রাউড়া গ্রামে বাবার বাড়িতে চলে আসেন এবং স্বামী সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতেই থাকতে শুরু করেন। ভাইয়ের সন্তানদেরও মায়ের আদর দিয়ে বড় করে তোলেন। এরপর তাঁর আরো দুটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। একটি মেয়ে জন্মের দু’ বছরের মাথায় শেয়ালের কামড়ে মৃত্য বরণ করে। আরেক মেয়ে ৩০দিন বয়সে মারা যায়। বর্তমানে তাঁর দুই মেয়ে আছে। তাদেরকেও শিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন।
রওশন আরার বিয়ের প্রায় ১০ বছরের মাথায় তাঁর স্বামীও মারা যান। বাবা, ভাই এবং স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি আরো অসহায় হয়ে পড়েন। তখন সারাদিন বাড়িতে থেকে তাঁর দুই মেয়ে ও ভাইয়ের সন্তানদের দেখাশুনা করতেন। কিন্তু এসব করে তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। সংসারে অভাব না থাকলেও তাঁর বাইরে গিয়ে কাজ করতে ইচ্ছা করতো।একদিন তিনি জানতে পারলেন একটি বেসরকারী সংস্থায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। আবেদন করলেন, চাকুরিও হয়ে গেল। লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের একমাত্র শিক্ষক হিসেবে তিনি ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন। এরপর উক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাড়িতে বসে থাকতে তাঁর ভালো লাগতোনা।
বাড়িতে থেকে আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াতে শুরু করলেন। এর বিনিময়ে কেউ কিছু দিলেও তিনি সেটা গ্রহণ করতেন না। তাঁর কাছে তখন গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েই পড়তে আসতো। এই বিষয়টি যখন জানাজানি হয় এবং তাঁর আগ্রহের কথা শুনে পার্শ্ববর্তী গিডুরপাড়া গ্রামের একজন ধনী ব্যক্তি স্কুল তৈরির জন্য জায়গা দিলেন। তাঁর জায়গায় ও গ্রামের সকলের সহযোগিতায় ঐ গ্রামে ২০০৩ সালে তিনি একটি স্কুল তৈরি করেন। বেসরকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে স্কুল তৈরির সমস্ত খরচ তিনি নিজে বহন করেন। মাত্র ৭জন ছাত্র নিয়ে প্রথম স্কুল চালু হয়। তাদের জন্য খাতা, কলম তিনিই কিনে দিতেন। গ্রামের মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের স্কুলে ভর্ত্তি করার কথা বলতেন। কিছুদিনের মধ্যেই উক্ত গ্রামসহ পাশের গ্রাম থেকেও অনেকেই এই স্কুলে আসতে শুরু করে।
শিক্ষার্থী সংখ্যা যখন বাড়তে লাগলো তখন স্কুলটিতে ধীরে ধীরে প্লে, নার্সারি ও কেজি ক্লাসে উন্নীত করলেন। বেতন হিসেবে তখন তেমন কিছুই পেতেন না। যে যা দিতো তাই নিতেন। নিজের টাকা খরচ করে স্কুলে টিউবওয়েল, টয়লেট ইত্যাদি স্থাপন করলেন। স্কুলের পরিবেশ দেখে যখন শিক্ষার্থীসংখ্যা বাড়তে থাকলো, তখন একার পক্ষে সব ক্লাসে পড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তিনি আরো তিনজন শিক্ষক নিয়োগ দিলেন। কেজি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতেও ক্লাস নেয়া শুরু করলেন। তৃতীয় শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অন্য স্কুলে ভর্ত্তি হতো।
উক্ত স্কুলের জমিদাতা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলে কিছু অসাধু লোকের প্ররোচণায় তাঁর পরিবারের লোকজন রওশন আরাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে লাগলো। তিনি এখানে যাতে স্কুল চালাতে না পারেন, তার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে থাকলো। একসময় তিনি নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে, সম্মানের কথা চিন্তা করে স্কুল ছেড়ে চলে আসেন। তবে ঐ গ্রামের লোকজন তাঁকে আসতে দিতে চায়নি। তারা বলেছিলেন, এখানে আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সকল ব্যবস্থা করে দিবেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না।
খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০০ শত শিক্ষার্থী এই স্কুল থেকে শিক্ষা লাভ করে। তাঁর অনেক ছাত্রী নেত্রকোণা শহরের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্ত্তির সুযোগ পেয়েছে। তাঁর কাছে হাতেখড়ি হওয়া একজন ছাত্রী এসএসসিতে জেলা পর্যায়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। স্কুলের একদম প্রথম দিকের এক ছাত্র বরিশাল মেডিকেলে পড়ছে। অনেকেই এখন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। তাঁর কাছে পড়ালেখা করা ছাত্রদের মধ্যে ২/৩জন ছাত্র নেত্রকোণা শহরের ‘খান কি-ার গার্টেন এসোসিয়েশন’ থেকে প্রতিবছর বৃত্তি পেয়েছে। এছাড়া অনেকেই পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে খুব ভালো ফলাফল করেছে। ২০০৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই স্কুল চালিয়েছিলেন।
গিডুরপাড়া গ্রামের স্কুল ছেড়ে তিনি ২০১৯ সালে নিজ গ্রাম বায়রাউড়াতে ‘ঝলক আদর্শ কি-ার গার্টেন’ নামে আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মামার দেয়া ১০ শতাংশ জায়গার অর্ধেকটাতে স্কুল এবং বাকি অর্ধেকটাতে নিজে থাকার জন্য একটি ঘর তোলেন। এই স্কুল ঘরটিও সম্পূর্ণ তাঁর নিজের খরচে স্থাপন করেন। এটি একটি ধানের জমি ছিল। সেখানে মাটি ভরাট থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া পর্যন্ত সকল কাজ তিনি নিজেই করেছেন। ৭৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। নেত্রকোণা সদরের উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে স্কুল রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। সরকারি সহযোগিতা হিসেবে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু বই পেয়েছেন। এছাড়া স্কুলের সমস্ত উপকরণ তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে সংগ্রহ করা। বর্তমানে করোনার কারণে স্কুলের সকল কার্যক্রম বন্ধ আছে। তাঁর সহযোগি হিসেবে তিনি এই স্কুলে তিনজন শিক্ষিকা নিয়োগ দিয়েছেন। এই স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।
রওশন আরার অবর্তমানে তাঁর মেয়েরা এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন। তবে নিজে যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এর সকল দায়ভার তিনিই বহন করতে চান। শুধু বায়রাউড়া গ্রাম নয়, আশেপাশের অনেক গ্রামে তাঁর হাতে তৈরি অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। শুধু তাঁর শিক্ষার্থীরা নয়, সকলেই তাঁকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। অশিক্ষিত, দরিদ্র শ্রেণির ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করার উদ্যেশ্যেই তিনি এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আমাদের সমাজে অনেক বিত্তবান মানুষ রয়েছেন। তবে সমাজের মানুষদের উন্নয়নের জন্য তাঁরা কোনো কাজ করতে চায়না। রওশন আরা সাহস করে, মনোবল নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাঁর মতো যদি আরো কয়েকজন রওশন আরা থাকতেন তবে আমাদের সমাজে নিরক্ষর নামক শব্দটি চিরদিনের জন্য মুছে যেতো।