ভেষজ শিক্ষক আব্দুল হামিদ’র প্রতি শ্রদ্ধা আর অভিবাদন
নেত্রকোনা থেকে মো. আলমগীর
নেত্রকোণা কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল হামিদ (৫৪)। সাত ভাই বোনের মধ্যে চতুর্থ হামিদ বলেন, “স্বাধীনতার পর পরই ১১/১২ বয়সী বড় বোনকে বিনা চিকিৎসায় কামেলা (জন্ডিস) রোগে মৃত্যুবরণ করতে দেখি। পরিবারের এই বিপর্যয়ের পর থেকেই আমি মানুষের বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি এবং গাছ-গাছড়ার ভেষজ গুণাগুণ ও ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে শুরু করি, স্থানীয় কবিরাজ, প্রবীণ ব্যক্তিদের নিকট থেকে বিভিন্ন ধরণের গাছ-গাছড়া, গুল্ম-লতাপাতা সম্পর্কে ধারণা নেই এবং এভাবেই গাছ-গাছড়ার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মায়।”
গ্রাম্য কবিরাজ হামিদ মাত্র ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার পর পুরোপুরি কৃষিকাজ এবং গ্রামের প্রবীণ ভেষজ কবিরাজ আঃ হেকিমের সাথে ঔষধি গাছ সংরক্ষন, ঔষধ তৈরি এবং ব্যবহার কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হন। এক পর্যায়ে তিনি এলাকায় গুণী কবিরাজ হিসাবে গ্রামের মানুষদের আস্থা অর্জন করেন। গ্রামের মানুষদের সহায়তায় তিনি বাড়িতে ৭০ প্রজাতীর ঔষধি গাছ সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অসহায় মানুষদের বিনা পয়সায়, স্বল্প মুল্যে জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গ্রামে যেকোন আগ্রহী সমমনা মানুষকে তার জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশল শিখিয়ে দক্ষ কবিরাজ হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেন। তিনি সব সময়ই তার এলাকার মানুষদের সাথে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক আলোচনা এবং বৃক্ষ রোপণ, গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করে উদ্বুদ্ধ করেন। বিলুপ্তপ্রায় ঔষধি গাছগুলো তার বাড়িতে রোপণ ও সংরক্ষণ করা শুরু করেন।
আব্দূল হামিদ কবিরাজ ২০০৬ সালে নেত্রকোণায় একটি কর্মশালায় যোগদান করেন। সেখানেই তার সাথ পরিচয় হয় তৎকালীন জেলা প্রশাসকের। কথা হয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক তাকে তার বাংলোতে কিছু ঔষধি গাছের চারা রোপণের অনুরোধ করলে তিনি গ্রাম থেকে চারা সংগ্রহ করে বাংলোতে একটি ঔষধি গাছের নার্সারি তৈরি করেন। পরে ধীরে ধীরে তিনি নেত্রকোনা কৃষি ফার্ম’র মসজিদ মাঠ, পশুর হাসপাতাল ও বিএডিসি’র পরিত্যক্ত ভবনের ছাদে ও সার্কিট হাউজ মাঠে ঔষধি নার্সারি গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার নার্সারিতে ৩৫০ প্রজাতির ঔষধি গাছের চারা রয়েছে।
সার্কিট হাউজ সংলগ্ন হাসপাতাল রোডে তিনি ‘এলিফা ভেষজ ঔষধের দোকান’ দিয়েছেন। উক্ত দোকানে ভেষজ সরবত, চা, গাছ-গাছড়ার ছাল, বাকলসহ তার সংগৃহিত সকল গাছের নির্যাস বিক্রি ও বিনামূল্যে বিতরণ করেন। তার দোকানে তৈরি ঘৃতকুমাড়ী, ইছবগুল, তুকমা ইত্যাদি দ্বারা তৈরি শরবত শহরের বিখ্যাত শরবত বলে জন পরিচিত। গরমের সময় ভেষজপ্রেমিক মানুষেরা তার দোকানে ভীড় জমায় পাঁচ টাকা ও দশ টাকা গ্লাস মূল্যের শরবত খেতে।
শুধু প্রসিদ্ধ কবিরাজই নয় আব্দুল হামিদ একজন রসিক মানুষও। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে গ্রামীণ ছড়া, শুলক, খনার বচন ও গাছ নিয়ে গান-কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে মানুষকে তিনি বিনোদন দিয়ে থাকেন। আনন্দ দিয়ে নার্সারির তথ্য, বৃক্ষ রোপণ, গাছের গুণাগুণ এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকেন।
তিনি বিভিন্ন অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায়) গিয়ে ঔষধি গাছের পরিচিতি, গুণাগুণ, ব্যবহার বিধি নিয়ে কথা বলেন (ক্লাশ নেন) এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের ঔষধি চারা রোপণে উদ্বুদ্ধ করেন। গাছের চারা রোপণে আগ্রহী মানুষদের মাঝে তিনি বিনামূল্যে চারা বিতরণ করেন এবং প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়ে চারা রোপণের পরামর্শ ও কারিগরী সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। প্রতিদিনই মানুষ গাছ সম্পর্কে জানতে, শিখতে ও গাছ চিনতে আসেন তার নিকট।
আব্দুল হামিদ কবিরাজ বলেন, “গত দুই বছরে তিনি বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১০,০০০ (দশ হাজার) ঔষধি গাছের চারা বিনামূল্যে মানুষকে বিতরণ করেছি”। তিনি বলেন,“ গ্রামের মানুষ এখনও ভেষজ ঔষধের ব্যবহার ও সংরক্ষণ করলেও শহরে এর ব্যবহার ও সংরক্ষণ নেই বললেই চলে। পাশাপাশি শহরে ঔষধি গাছের অস্তিত্বও দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে শহর সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্ম ঔষধি গাছ-গাছড়া ও বিভিন্ন রোগে এসবের ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে জানতেই পারবে না। শহরের অধিকাংশ মানুষ ভেষজ ঔষধি ছেড়ে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এলোপ্যাথিক ঔষধে ভেজালের ফলে মানুষ দিন দিন বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।”
প্রকৃতি প্রেমী ও বৃক্ষপ্রেমী এই মহান মানুষের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।