চরাঞ্চলের মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবিকায়ন
মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম
কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষেণে চরাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অংশের দাবিদার। আমরা জানি, সাধারণত চরাঞ্চল দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযুদ্ধের অরক্ষিত বসতি রয়েছে। চরাঞ্চল ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার প্রাপ্তিতেও পিছিয়ে। চরাঞ্চলে রয়েছে নদীভাঙ্গন, বন্যা, খরা ইত্যাদি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং টিকে থাকার ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা। এই মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের টেকসই জীবিকায়নে নিরলসভাবে কাজ করছে।
মানিকগঞ্জে ’বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্র ও হাটা দিবসের প্রথিক দল’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিবছর ৪ জানুয়ারি জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জীবনমানের খোঁজে সারদিন পায়ে হেটে এই জনপদের মানুষে জীবনকে গভীরভাবে বুঝতে ‘হাটা দিবস’ পালন করেন। আমি এই টিমের একজন সদস্য হওয়াতে প্রতিবছর সবাইকে নিয়ে খুবই আনন্দ উপভোগ করি। সেই ধারবাহিকতায় এই বছর গত ৪ জানুয়ারি টিমের গন্তব্য ছিলো মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার জাফরগঞ্জ, বাঁচামারা, বাঘুটিয়ার যমুনার তীর ঘেঁষে দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতদূর যাওয়া যায়।
জাফরগঞ্জ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আমাদের টিম লিডার পালের গোঁদা শাহাদত হোসেন সাঁইজি’র আহবানে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনকে কাছ থেকে দেখতে ও জানতে করণীয় বিষয়ক ধারণা নিয়ে কথা বলেন জ্ঞানের প্রদীপ আল্লামা অনিশ আজাহার উদ্দিন, ভ্রমণ পিপাসু অধ্যাপক মুকুল আহমেদ, সাহিত্য প্রেমী কামরুল মাস্টার, বাঁচিক শিল্পী ওস্তাদ আতিকুর রহমান মিঠু, প্রকৃতি প্রেমিক এম এ মুন্না সিএ ও উন্নয়নকর্মী মো. নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
হাটা দিনের অনেক কথা হলেও জানতে হবে মানুষের জীবন কথা। যাহোক জাফরগঞ্জ বাজারে চায়ের আড্ডার ফাঁকে স্থানীয় মুরুব্বীদের মাধ্যমে চরের জীবন জীবিকায়ন বৈচিত্র্য ও চারপাশের যোগাযোগ ব্যবস্থার খোঁজখবর নিলাম। তারপর যমুনার তীরে ধরে অজানা পথে প্রাণ ও প্রকৃতি দেখতে দেখতে মানুষের খোঁজে রওনা হলাম। ধুধু সাদা বালি মাঝে মাঝে খানা খন্দে জমে আছে পরিস্কার পানি। নীলাভ বর্ণের পানি ও চোরাবালি মিশ্রিত মিষ্টি ঢেউ, মৃদু বাতাস ও চারিদিকে বিশালকারে খেসারি, মটর, কালাই ও সরিষা ক্ষেতে পাখির কলরব যেন এক অন্য রকম অনুভূতি। আমরা সবাই দুচোখ ভরে দেখি ও ভাবি বাড়ির কাছেই আরশি নগর কোথায় মোরা থাকি। আমাদের সাথী গুরু আজাহার বলেন, ‘আসলে বিচার করে দেখনা আমরাও কক্সবাজারের কাছাকাছি।’ যাহোক তারপরই পথেই দেখা হলো মানিকগঞ্জ জেলা দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ধুবুলিয়ার চরে আদর্শ কৃষক আলিম সিকদারের সাথে। চরের ফসল ও তাদের জীবন জীবিকায়ন নিয়ে কথা হলো তার সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় নদী ও প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে কাজ করি, বলতে গেলে একধরনের অতিথি পাখি। নদী ভাঙে নদী জাগে চর হয়, ঘর ভাঙে বাড়ি ভাঙে, আমাদের মন ভাঙে। সব কিছু দেখানো যায় না। গত কয়েক বছর ধরে চরে ভালো ফসল হয়, তাই বাপ দাদার আমলের জমিজমার খোজও করছে অনেকে। এখানে সার বিষ, কীটনাশক লাগে না, এমনিতেই ফসল হয়। তারপর যারা বর্গা ও বন্ধক চাষ করে তারা বেশি ফসলের লোভে রাসায়নিক ব্যাবহার করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমার নিজের জমি চাষ করি। তাই এগুলো ব্যাবহার করি না। আমাদের এখানে সরকারি ও বেসরকরি তেমন কোন সুযোগ সুবিধা পেছৈায় না, সরকারি কৃষি বিভাগ এগুলো দেখাশোনা করলে আমরা খুশি হই।’
আমরা আবার রওনা দিলাম সিরাজগঞ্জের চৌহালীর দিকে। চরের নাম জোতকাশির চর। সেখানে পেলাম আদর্শ কৃষক সুরমান মাতব্বরকে। তিনি বলেন, ‘আমরা খনেক রাজা খনেক প্রজা। ভাঙা গড়ার মধ্যে আছি টিকে। আমার বয়সেই আমার বাড়ি ১১বার ভাঙা দিয়েছে। তারপরও শুধু টিকে আছি এই মাটির ভরসায়। এই মাটি খুবই উর্বর, সকল ফসল হয় এবং গবাদি পশু পালন করে আমরা বেশ ভালো আছি।’ তার সাথে জীবনের গল্প অল্প করে সেরেই রওনা হলাম পাবনার বেরা উপজেলার কাজিরহাট চরের দিকে পথেই পেলাম যুবক কৃষক লোকমান মিয়া ও কদম আলীকে। তারা দুজনেই যুবক কৃষক গরুর ঘাস কাটছে। বাড়িতে গোয়াল ও পাল ভরা গরু। কদম আলী বলেন, ‘এখানে নিজেদে বলতে কোন জমি নেই। তবে বাপ দাদার নিশানা ধরে চাষবাস করে চলতে হয়। এখন চরে প্রচুর ফসল। তাই গরু ছাড়া মুশকিল বলে খেসারি ও মাশকালাই করেছি গরুর ঘাসের জন্যই। আমাদের এখানে বিদ্যুৎ নেই, সোলার ব্যাবহার করি, রাস্তা নেই ট্রলার/নৌকায় যাতায়াত করি। এগুলো সমাধান হলে আমরা আরো ভালো থাকি।’
হাটার পথেই টিমের বেশিরভাগই বলেন, ‘যাবই আজ তিন জেলার মোহনায়।’ যাহোক রাহাতপুর চরের পথে দেখছি একটি ভাসমান ডেরা। এখানে এসে কথা হলো রাজনীতিক ও সমাজসেবক এস এম জাহিদের চাচাতো ভাই এস এম রেজাউল করিম ও তার সহধর্মিণী জুলেখার সাথে। তাদেরই এই ভাসমান ঘর দেখে আতকে উঠলাম। এত বড় চরে কোন মানুষ রাতে থাকে না যেখানে, আপনারা কেমনে বসত করেন এখানে। রেজাউল করিম বলেন, ‘ভাই আমরা আসলে নিছকই সখ করে থাকি না। এখানে বাপ দাদার জমি আছে এবারও দুই খাদা মাশকালাই ও খেসারী ক্ষেত করেছি। মূলত এগুলো পাহারা দিতেই আমরা ঘরে বাইরে দুজনে রাত্রিযাপন করি। বেশ ভালো লাগে খুবই আনন্দে দিন কাটে। মোরা যেন জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা।’ সৌখিন মানুষ রেজাউল ভাই পাকা বাড়ি রেখে মাশকালাই ক্ষেত পাহাড়া দিতে ডেরাতুলে সারারাত কাটায় চরের মাঝে, ফসলের প্রতি তার এ ভালোবাসা আমাদেকে হার মানায়।
যাহোক দিনের আলো নিভে আসছে আর যাচ্ছে না সামনে যাওয়া। জাফরগঞ্জ ঘাটের পথ ধরেই উল্টো পথে দিলাম রওয়ানা। পথে দেখা হলো কৃষাণী সোভা রাণী ও সবিতা রাণী হালদারের সাথে। তাদের সাথেও কথা হলো বেশ। কৃষাণী সোভা রানী হালদার বলেন, ‘ঘাস কেটে, বাদাম কুড়িয়ে ও গরু ছাগল চরিয়ে সারাদিন আমাদের কাটে বেলা। আজকের মতোন ঘাস কাটা ও বাদাম তুলা শেষ। বাড়ি ঘর নাই ঠিকানা আছে ধুবুলিয়ার চরে, এখন যাচ্ছি সেখানে সন্ধা বয়ে যায়- গরু ছাগল হাঁস, মুরগি আমাদের ডাকছে কানের মধ্যে আসছে।’ অনেক সুন্দর হাসিমাখা মুখ নিয়ে প্রকৃতির ভাষা দিয়ে কথা বলছে তারা। তাদের কথা শুনতে শুনতে আমরাও যাচ্ছি বাড়ির পথে। কি আর করা পথিক দল আবার মোচর দিলো উজানপুর চরের দিকে। তাই হাত নাড়িয়ে বিদায় নিলাম সোভা রানী ও সবিতা রানী হালদারদের কাছ থেকে। আদর্শ কৃষক নুরু মন্ডল ও কাশেম ব্যাপারীর সাথে পথে দেখা হলো। মায়াবী দুজন চাচা বেশ গল্পের যাদুকর, মন তাদের ছেড়ে আসতে দিচ্ছে না। নুরু মন্ডল গল্প ভালো বলেন ও কাশম বেপারীর ভালো গান শুনালেন। চরাঞ্চলের জীবনন্ত মানুষ কাশেম বেপারীদের কেউ চিনেনা, জানেনা এটা তাদের নয় আমাদের দুঃখ। আমরা লোকায়ত চর্চার জন্য আদর্শ কৃষক হিসেবে এই মানুষগুলোর মূল্যায়ন চাই। সবার সাথেই অনেক কথা হলো তবুও কথা হলো না শেষ। তারা চরের মানুষ তাদের চরেই কাটে জীবন। ধান ফসলের মাঠ আর ভাওয়াইলা ধানের গোচা তারপর দেখি মাসকালাই ও খেঁসারি মাঠে চৈতা সরিষার ঘের। কতেক পরে পেলাম আরো কিছু সরিষার ক্ষেত। এমনিভাবে দেখতে দেখতে আসলাম ফিরে ঘাটে। জাফরগঞ্জ বাজারে একটি রেস্তেরায় পেটের ক্ষুদা মিটিয়ে সারাদিনের আনন্দ মনে নিয়ে বিদায় নিলাম সবার সাথে।
চরাঞ্চলের মানুষের জীবনের ছবি মনে মনে দেখে ও ভেবে পরিশেষে বলতে চাই, মানুষের জীবন সরলরৈখিক নয়। চরাঞ্চলের মানুষের জীবন যেমন কঠিন তেমন তাদের টিকে থাকার কৌশল ও ধরন বৈচিত্র্যময়। সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লোকায়ত চর্চা ও স্থানীয় সম্পদের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আরো টেকসই হবে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সমাজিক সংগঠনের সহযোগিতা থাকলে কৃষকরা সংগঠিত হবে, সমবায়ভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠবে। এভাবে যৌথকৃষি তথা সমাজভিত্তিক কৃষিজ উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি আরো মজবুত হবে।