বগা দিঘা ধান ডুবেও ভেসে থাকে
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর পদ্মা তীরবর্তী নিচু এলাকা হওয়ার কারণে খুব সহজেই বন্যার পানি মাঠে-ঘাটে চলে আসে। হঠাৎ টানা বৃষ্টি ও পদ্মায় পানি বেড়ে এলাকার মাঠ-ঘাট তলিয়ে সয়লাভ ও মাঠের ফসল নষ্ট হয়। গ্রামীণ জীবনে মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধানতম অবলম্বন কৃষি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আবহাওয়া পরিবর্তন, খড়া, অতি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও হঠাৎ বন্যার সাথে তাল মিলিয়ে চাষাবাদ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সফলতার মুখ দেখছে হরিরামপুরের কৃষকরা। এই সফলতার নাম হলো বগা দিঘা ধান যা এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে-যা জলবদ্ধতা বা অতি বৃষ্টিতে নষ্ট হয় না। এটি যেন ডুবেও ভেসে থাকার মতোই।
সরজমিনে হরিরামপুরে গিয়ে দেখা যায় দীর্ঘদিন চাষাবাদে কৃষকের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কৃষকরা নিজেই বুঝতেই পারে নাই এত তাড়াতাড়ি বন্যার পানিতে মাঠ তলিয়ে ধান নষ্ট হয়। খড়া, হঠাৎ অতিবৃষ্টি, বন্যা সব মিলিয়ে আবাদে তালে বেগুন অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করেন বর্তমানে এই বিরূপ পরিবেশে কখন কি হবে, তা বুঝা খুবই কঠিন। কৃষকরা পরিকল্পনা অনুযায়ী চাষাবাদ করতে না পারায়, আবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকৃতির বিরূপ পরিশের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষকের নিকট থেকে ফসল বৈচিত্র্যের বীজ ভান্ডার।
হরিরামপুর উপজেলার দাসকান্দি গ্রামের কৃষক কিসমত আলী (৫৫) আমন মৌসুমে দাসকান্দি চকে “বগা দিঘা” ধান চাষ করেন ৭ বছর ধরে। তিনি বলেন, “বিগত সময়ে এলাকায় বন্যা হলেও বগা দিঘা ধানের ফসল নষ্ট হয়নি। উৎপাদিত ফসল থেকে বগা দিঘা ধান বীজ রেখে চাষাবাদ করি। আমন মৌসুমে অন্যান্য জমিতে বগা দিঘা ধানসহ হিজল দিগা, ভাউয়াইল্যা, দুধ ভাউয়াল্যা ধান চাষ করি। সকল ধানই কম বেশি হয়। ফলে বীজ রেখে সকল কৃষকের সাথে আমিও চাষ করি।” তিনি আরো বলেন, “এবছর হঠাৎ বন্যায় বগা দিঘা বাদে সকল জাতের ধান নষ্ট হয়ে যায়। তবে বগা দিঘা ধান ১৫ দিন পানির নিচে ছিল, কুড়ি ছেড়ে আবার ধান হয়। আমি মোট ৮ বিঘা জমিতে ধান চাষ করি এর মধ্যে ২ বিঘা বগা দিঘা ধান বর্তমানে ভাল আছে। বাকি সব নষ্ট হয়ে যায়।” তিনি বলেন, “আমার কাছে এলাকার ২২ জন কৃষক বগা দিঘা ধান চাষাবাদের জন্য ধান বীজ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন । চাষাবাদে আমি জমিতে গোবর সার দিয়ে বগা দিঘা ধান চাষ ও অন্যান্য ফসল চাষ করি। ফলে আমার খরচ কম ও আমার জমির ধান গাছ শক্ত থাকে। সাধারণত কোন বন্যা ও খরার মত দুর্যোগে আমার জমির ধান নষ্ট হয় না।”
তিনি আরো জানান, জমিতে ২টি চাষ দিয়ে আগাছা বাছাই করে ৬০ শতাংশ জমিতে ৮ কেজি বগা দিঘা ধান ছিটিতে হয়। বৃষ্টির পানি ও বন্যার পানির সাথে তাল মিলিয়ে বগা দিঘা ধান বড় হয়। বগা দিঘা ধান চাষ করতে ধান বীজ ও জমি চাষ বাবদ খরচ ছাড়া অন্য কোন খরচ নেই। ৩০ শতাংশ জমিতে প্রায় ৮ মণ ধান হয়।
কৃষক দুলাল সিকদার দাসকান্দি (৪২) বলেন, “আমন মৌসুমে ধান চাষে বন্যার পানি হঠাৎ করে চকে আসায় আমরা খুবই বিপাকে পড়ে যাই। তবে বগা দিঘা ধান বন্যার পরবর্তীতেও ভালো আছে ও ধান হবে আশা করা যায়। আমন মৌসুমে মানিকগঞ্জের অধিকাংশ ধান ফসলের মাঠ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আমরা আমন ধানের বীজ সংগ্রহে জন্য নিয়ে চিন্তায় আছি। এজন্য যে ধান বন্যা ও খড়া সহনশীল এমন জাতের ধান বগা দিঘা চাষাবাদ করতে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।”
দাসকান্দি চকে কৃষকরা প্রায় ৬০০ বিঘা জমিতে আমন মৌসুম ২০১৬ হিজল দিঘা, ভাওয়াল্যা, ডেপর ধান চাষ করেন। কৃষকরা মনে করছেন এবারের বন্যায় তাদের নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। বর্তমানের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ কৃষকের প্রতিকূলে হওয়ায় তারা পরিবেশের সাথে সহনশীল বগা দিঘা ধান চাষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।