কৃষাণী মায়া খাতুনের কৃষি সফলতার গল্প
সাতক্ষীরা থেকে মুকুন্দ ঘোষ
প্রাচীন যুগে নারীর হাতে বোনা বীজ দিয়ে চাষাবাদের প্রচলন হয়েছে, মানুষ পশুপালন সভ্যতা থেকে কৃষি সভ্যতার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে কৃষিক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কতটুকু তা সহজেই জানা যায়। গ্রাম বাংলার নারীদের কাছেও অনেক কাজের মধ্যে কৃষিই গুরুত্বপূর্ণ। বীজ সংরক্ষণ ও বপন থেকে শুরু করে, চারা রোপণ, সেচ, ফসল উত্তলন এমনকি বিপণনেও নারীরা এককভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। পুরুষের পাশপাশি নারীরাও কৃষিসহ নানান উন্নয়নে কান্ডে অতীবও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে চলেছে।
পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে নানাভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে। তেমনি একজন উদ্যোগী নারী মায়া খাতুন। পারিবারিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে স্বামীর পাশাপাশি নিজের বসতভিটার ১৬ শতক জায়গাতে সবজি চাষ করছেন মায়া খাতুন। নিজের তৈরি করা সবজি থেকে নিজের পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে পারিবারিক কিছু খরচ ও সঞ্চয় করতে পারে এমনটাই জানালেন তিনি।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলবর্তী দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার মেয়ে মায়া খাতুন (৩৬)। মায়া খাতুন ছয় ভাই বোনের ভিতরে সেঝো মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছিলো মাত্র ১২ বছর বয়সে। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করার সুযোগ হয়েছিল তার। মায়া খাতুনের স্বামী সোহরাব আলী (৪৫) পরিবারে হাল ধরতে তার পড়ালেখা আটকে দ্বিতীয় শ্রেণীতেই। সোহরাব আলীর প্রধান পেশা হলো নদীতে মাছ কাঁকড়া আহরণ করা। মায়া খাতুন তিন কন্যা সন্তানের জননী। বড় মেয়ে ঝর্ণা খাতুন (২১) মেঝো মেয়ে আশুরা কে (১৮) বিবাহ দিয়েছেন একই ইউনিয়নের মধ্যেই। ছোট মেয়ে ছায়রা (১৫) ক্লাস নাইনে পড়ে।
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে নেটর্জ পাটনারশিপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টির সহযোগিতায় জাতীয় পরিবেশ পদক প্রাপ্ত সংগঠন বারসিক এর বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে ডুমুরিয়া গ্রামের কপোতাক্ষ সিএসও দলে যুক্ত হয় মায়া খাতুন। পরিবার উন্নয়ন পরিকল্পনায় ছাগল নিলে পরিবারের ইনকাম বাড়বে উল্লেখ করে মায়া খাতুন। বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে সহায়তা হিসাবে দুইটি ছাগল দুইটি গাছের চারা সাত প্রকারের বীজ ও পাঁচটি হাঁস পান। বছরের কয়েক মাস খোল পেটুয়া নদীতে মাছের পোনা সংগ্রহ করে স্বামী আর কয়েক মাস দিন মুজুরের কাজ করে এমনটাই জানাল মায়া খাতুন। নিজের পারিবারিক খরচ এবং মেয়ের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে অল্প কিছু টাকা সঞ্চয় করেন।
মায়া খাতুনের কাছে কৃষি সফলতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বারসিক থেকে জলবায়ু সহনশীল কৃষি চর্চা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং নিয়মিত মিটিং থেকে লবণ সহনশীল সবজি চাষ সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে সবজি চাষ করে সফল হতে পেরেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার বসতভিটার উৎপাদিত সবজিতে সার হিসাবে গর্ত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করি। যার ফলে সবজি উৎপাদনে পানি খরচ কম হয় এবং জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে।’ মায়া খাতুনের সবজি ক্ষেতে বিভিন্ন প্রকার সবজি আছে, যেমন কলমি শাক, পুইশাক, কচুরমুখি, শসা, ঢেড়স, করলা, ধুন্দল, ঝিঙ্গা, কচু ইত্যাদি। ফলজ গাছ হিসেবে আছে নরিকেল, খেজুর, কদবেল, জামরুল, কুল, আম, ইত্যাদি। মায়া খাতুন জানান এখান থেকে পারিবারিক সবজির চাহিদা পূরণ করে বাকি ফসল বিক্রয় করে পরিবারের অন্যান্য খরচ বহন করে ও একটু একটু সঞ্চয় জমা করছি। নিজ হাতেই তুলনামূলক সবল সতেজ ও অনেক উপযুক্ত ফলটাকে বীজ উৎপাদন এর জন্য রেখে দেন। পরে পাকা ফল থেকে পরবর্তী সময়ের জন্য বীজ সংরক্ষণ করেন।
দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার লবনাক্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে তার কৃষি উদ্যোগ স্থানীয় অনেক মানুষের মনে সাড়া ফেলেছে। তার এই কৃষি সফলতা একদিকে যেমন তার পারিবারিক আয়ের পথ সৃষ্টি অপরদিকে তেমনি পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষায় ভুমিকা রাখবে।