নারীদের সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে
মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম
মানব জাতির ইতিহাস ও সৃষ্টির কারিগর হিসেবে নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক হলেও অধিকারের জায়গায় রয়েছে বিশাল বৈষম্য। জেন্ডারগত দিক থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে শারীরিক ও অবয়বগত কিছু পার্থক্য ছাড়া তেমন কোন পার্থক্য না থাকলেও সমাজ নারীর ও পুরুষের পোশাক, পরিচ্ছেদ,খাওয়া দাওয়া কাজ ও শ্রম বিভাজনে করেছে ব্যপক ব্যবধান। ইসলাম ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্মেও নারী পুরুষের সমান অধিকার এর কথা বলেছে। অন্যদিকে সম্পদের মালিকানা নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। নারী নেত্রী,নারী সংগঠন ও প্রগতিশীল সুশীল সমাজের যৌথ আন্দোলনের ফসল হিসেবে আমরা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ পেলেও এখনো সেটি আলোর মুখ দেখেনি। সম্পদ ও অধিকারের দিক থেকে বৈষম্যের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সবাই মিলে ভাবো নতুন কিছু করো, নারী পুরুষ সমতার নতুন বিশ^ গড়ো’ এই দিবসের পেছনে রয়েছে অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মানির্কন যুক্তরাষ্ট্রের নিউওয়ার্কের রাস্তায় নেমেছিলে সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। দাবি বাস্তবায়ন না করে তারা ঘরে ফিরবে না এই প্রত্যয় করলে তৎতকালীন সরকারের লাঠিয়াল বাহীনি দমনপীড়ণ করে এবং অনেক নারী শ্রমিককে আটক করা হয়। এই ঘটনাকে স্মরণ করে ১৮৬০ সালে তারা নারী শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করেন এবং সংগঠিত হতে থাকে নারী শ্রমিকদের আন্দোলন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে নিউয়ার্ক সোসাল ডেমোক্রাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন এর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা জেটকিন ছিলেন জার্মানি কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতীদের একজন। তারপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগে শুরু হয় আন্তর্জাতিক ২য় সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে একশ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সালে এই দিনে নারীদের সম অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস পালন করে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকে এই দিবসটি পালন করে। অতপর ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ থেকে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকেই সারা বিশে^র সকল রাষ্ট্র তাদের মত করে প্রতিপাদ্য নির্ধান করে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে আসছে।এই দিনে বিশ্বের অনেক দেশ দিবস পালনের পাশাপাশি সরকারি ছুটিও ভোগ করেন।
আমাদের সমাজে নারীর বর্তমান অবস্থা
বর্তমান যুগকে বলা হয় একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তনের যুগ, বিশ^ায়নের যুগ, সমতার যুগ বৈষম্য নিরসনের যুগ গণতান্ত্রিক যুগ। অন্যদিকে পুঁজিবাদি এই বিশে^ নারী এখন বিজ্ঞাপন ও পণ্যে পরিণত হয়েছে। ঘরে বাইরে সর্বত্র নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ, যৌতুক, যৌন হয়রানি, ইভটিজিংসহ শারিরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নিপীড়ন ও নির্যাতন উপেক্ষা করে নারীরা ঘরে ও বাইরে কাজ করছে নিরলসভাবে এবং অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে। জ্ঞান, বিজ্ঞান শিক্ষা স্বাস্থ্য ও গবেষণাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর পদচারণা লক্ষ্যণীয়। তারপরও তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পারিবারিক কাজে নেই তাদের মজুরি মর্যাদা এমনিকি আপনজনের কাছ থেকেও নির্যাতন ঠেকানো যাচ্ছে না। কর্মস্থল পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। নারী দিবসসহ নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন সচেতনার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিতের জন্য কাজ করছে। সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের অবস্থার উন্নতি করা না গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নারী নির্যাতনের মাত্রা আগের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে। সারা বিশে^ এই দিবসটির মাধ্যমে জেন্ডার সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতার ম্যাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারসহ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় না থাকার কারণে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা ও বাধা। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে আমরা দেখতে পাই, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার নারীর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারে না, শিক্ষার হার বাড়লেও বাল্য বিবাহের কারনে মেধার বিকাশ ঘটছে না, প্রকৃত শিক্ষিত না হওয়ায় সচেতনতার মান বাড়ছে না, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর প্রবেশাধিকার না থাকায় ক্ষমতায়ন হচ্ছে না, গৃহস্থালী কাজে নারীর মজুরি মর্যাদা ও স্বীকৃতি নেই, কৃষিকাজে নারীর অবদানকে দুর্বল করে দেখা হচ্ছে, এ রকম বিভিন্ন সমস্যায় নারীকে আটকে ও দুর্বল করে রাখা হচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিতে আমাদের করণীয়
নারীর উন্নয়ন বলতে নারীর ক্ষমতায়ন কাজের যথাযথ মূল্যায়ন ও সকল ক্ষেত্রে প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠাকে বুঝায়। নারী উন্নয়নে পুরুষের দুষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনসহ সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করা উচিত। আমরা মনে করি, নারীর প্রধান শক্তি হলো তার শিক্ষা। নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটলে ও সাংস্কৃতিক চর্চা বিরাজমান থাকলে আয় বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে ছাত্র যুবক সেচ্ছাসেবী সামজিক সংগঠনের তৎতপরতা আরো বাড়াতে হবে এবং রাষ্ট্রকে প্রধান ভূমিকা নিতে বাধ্য করাতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী পুরুষের সমান মর্যাদা দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। সেটি ধরেই সামাজিক আন্দেলনের মাধ্যমে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশে নারীর উন্নয়নের জন্য অনেক আইন হয়েছে যেমন বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, পারিবারি নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, পারিবারিক ভরণ পোষণ আইন, চলাফেরায় ও বৈষম্যের শিকার যেন না হয় তার জন্য নারীর সুরক্ষা আইন এবং ইভটিজিং ও যৌন হয়রনি বিরোধী আইনসহ আরো অনেক আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্থবায়ন নেই বললেই চলে। এগুলো বাস্তাবায়নে চাপ সৃষ্টিকারি গোষ্ঠীগুলোকে আরো তৎপর হতে হবে। বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পোশাক শিল্প। এখানে প্রায় ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করে। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, কর্মঘন্টা ও ন্যায্য মুজুরির বিষয় নিয়ে সরকার ও নীতি নির্ধারকরা অনেক কথা বললেও এখনো পোশাক শিল্পে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত ও নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়নি। এগুলো সৃষ্টি করতে পোশাক শ্রমিকদেরকে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে। নারীর অধিকার আদায় করতে হলে অবশ্যই গ্রাম পর্যায় থেকে নারী সংগঠন, কিশোরী সংগঠন ও যুব সংগঠনের মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরিতে সরকার ও সুশীল সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য শুধু এই দিবস উদযাপনই যথেষ্ট নয়, সারাবছরই কাজ করতে হবে ঐক্যব্ধভাবে। অনেকের মতে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস এখন একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে যার বাস্তব সফলতা খুবই নগন্য। নারীর মজুরি শ্রমঘণ্টা ও অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করেই নারী দিবসের জন্ম হয়েছে তাই এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক স্মারক দিবস। নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ছিল এই দিনটির আন্দোলন। আমরা যদি নারীর অধিকার আদায়ে যারা লড়াই করেছে শ্রম ও অবদান রেখেছে তাদের দেখানো পথে কাজ করি তবেই নারী ও পুরুষের সামাজিক ন্যায্যতা সাংস্কৃতিক চর্চা ও জেন্ডার বৈচিত্র্য সুরক্ষার পথ আরো বেগবান হবে।