জলাভূমি দূর্যোগ ঝুঁকি কমায়
পাভেল পার্থ
প্রতিটি ভূগোলের এক একরকম মায়া ও দাগ থাকে। এই মায়া ও দাগেরই আরেক নাম দর্শন ও যাপন। বাংলাদেশের মায়া ও দাগের পরিধি জন্ম নিয়েছে দেশের জলধারার বিস্তৃত পরিসরে। এ যেন জল-দর্শন, জন্ম ও মৃত্যু সবই জলজীবন ঘিরে এখানে আবর্তিত। এখানে জলাভূমি মানে তাই জীবন বিকাশের আরেক রূপ। পাহাড়ি ঝিরি কি ছড়া থেকে শুরু করে পুকুর, দীঘি, হ্রদ, বিল, বাওড়, হাওর, খাল, নদ, নদী জলাভূমির এমনই কত না রূপ বাংলাদেশে। এক একরকম জলাভূমি মানেই এক এক রকম জংগল। এক এক রকম জলাভূমি মানেই এক এক রকম ধান। এক এক রকম জলাভূমি মানেই এক এক রকম গান। সুনামগঞ্জের হাওর জলাভূমির বিস্তার রাধারমণ কি করিমের গীতবৈভবের জন্ম দিয়েছে। পাবনা-সিরাজগঞ্জের চলনবিল ধুয়া নামের এক বিবরণধর্মী গানের আঁতুরঘর। কিন্তু দেশজুড়ে জলাভূমিরা নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণা পাড়ি দিয়ে চলেছে। জলাভূমি জীবনের করুণ আহাজারি ফালি ফালি করে রাষ্ট্র লাগাতার উন্নয়নের জুলুম চালিয়েই যাচ্ছে।
পৃথিবীজুড়ে বর্তমান সময়ে অবশিষ্ট জলাভূমির মোট পরিমান ৫৪ লাখ বর্গ কিমি থেকে ৫৭ লাখ বর্গ কিমি এর ভেতর। ইরানের রামসার শহরে ১৯৭২ সনের ২ ফেব্রুয়ারি রামসার সম্মেলনে প্রথম পৃথিবীর জলাভূমি বিষয়ে আন্তজার্তিক মনোযোগ তৈরি হয়। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল জলাভূমি এলাকার জলচর পাখিদের পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে ঠিক রাখা। রামসার সম্মেলনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া ‘রামসার ঘোষণার’ প্রথম শর্ত হচ্ছে, চুক্তিভূক্ত সদস্য রাষ্ট্রপক্ষ রামসার অঞ্চল হিসবে ঘোষিত জলাভূমি এলাকার মানুষ এবং তার পরিবেশের আন্তঃসম্পর্ককে বিবেচনা করবে এবং গুরুত্ব দিবে। সারা দুনিয়ার বর্তমানে ২০০০টি জলাভূমি রামসার ঘোষণার মাধ্যমে ‘রামসার অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ রামসার ঘোষণার একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। সুন্দরবন ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দু’টি রামসার অঞ্চল। ১৯৯২ সনের ২১ মে সুন্দরবনের ৬,০১২০০ হেক্টর এলাকাকে দেশের প্রথম রামসার অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০০ সালের ১০ জুলাই দেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা হিসেবে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু রামসার এলাকা দু’টি এখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র ঘোষণা হিসেবেই রয়ে গেছে। আর এদের উপর দিয়ে চলছে নির্দয় উন্নয়ন-বাণিজ্যের বাহাদুরি। টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে হাওরবাসীর সাথে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের দরবার থামে না। উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কোলে বিস্তৃত এই হাওরে মেঘালয় পাহাড়ের কয়লা কি চুনাপাথর খনি থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে নামে বালি-পাথরের ঢল। রামসার এলাকা হয়েও সুন্দরবনের জলপ্রবাহগুলো বছর বছর উজানে বাঁধ, বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের কি লাগাতার অসহ্য বাণিজ্যিক নৌযানের মাস্তানিতে লন্ডভন্ড।
১৯৯৭ সনের আগেও বিভিন্ন উদ্যাগ নেওয়া হলেও এ সন থেকেই প্রথম প্রতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়। প্রতিবছরই পৃথিবীর জলাভূমি সমূহের গুরুত্ব এবং এর সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং উন্নয়নধারাকে বিবেচনা করে প্রতিবছরের জন্যই এক একটি প্রতিপাদ্য তৈরি করা হয়। ২০০৬ সনে জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমিসমূহ এবং পানিনির্ভর জীবন ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা’, ২০০৭ সনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আগামীর জন্য মাছ?’, ২০০৮ সনে ‘স্বাস্থ্যকর জলাভূমি, স্বাস্থ্যকর জনগণ’, ২০০৯ সনে ‘নদী ও নদী তীর ব্যবস্থাপনা’, ২০১০ সনে ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ু পবির্তন’, ২০১১ সনে ‘জলাভূমি ও জংগল’, ২০১২ সনে ‘জলাভূমি ও পর্যটন’, ২০১৩ সনে ‘জলাভূমি ও পানিব্যবস্থাপনা, ২০১৫ এবং ২০১৬ সনের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি সমূহই আমাদের ভবিষ্যত’। ২০১৭ সনে প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘জলাভূমি দূর্যোগ কমায় বা জলাভূমি দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস করে’। জলাভূমি দূর্যোগের ঝুঁকি কমায়, আর রাষ্ট্র জলাভূমি খুন করে। ধনী, প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা, কর্পোরেট কোম্পানি সকলেই তো হরদম জলাভূমি দখলে উন্মত্ত। হাওর, বিল থেকে শুরু করে নদী কী ঝর্ণা পর্যন্ত এক নিমিষে উধাও করে দিতে এরা মারাদাঙ্গা। নির্বিচার এই জলাভূমি ছিনতাইয়ের কোনো বিচার নেই। কোনো প্রশ্ন নেই।
সুন্দরবনকে অনেকে ইউনেস্কা ঘোষিত ৫২২নং বিশ্বঐতিহ্য এবং ৫৬০তম রামসার অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি এ বন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ইরাবতী ডলফিনের সর্ববৃহৎ বিচরণস্থল। ১৯৯৯ সনে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কি.মি. এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সবচে’ বড় কথা সুন্দরবন বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনভূমি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ এর ৩নং বিধি অনুযায়ী প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার জলাভূমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনে নৌপথসহ সকল ধরণের কর্মকান্ডই আইনত নিষিদ্ধ। বিস্ময়করভাবে ২০১১ সনে সুন্দরবনে ঘোষিত হয়েছে তিনটি ডলফিন অভয়াশ্রম। অথচ এসব সংরক্ষিত অঞ্চল কি আইন ধারা সবকিছু লন্ডভন্ড করে সুন্দরবনে চলছে ভারী জলযান, ঘটছে বিপর্যয়। প্রতিটি ঘটনার পর রাষ্ট্র একে বলে দিচ্ছে ‘দূর্ঘটনা’। ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সাথে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেল মংলা নালা ও রামপালের কুমার নদ ভরাট হয়ে প্রায় ৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। তখন থেকেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীকে নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সনের ২৪ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ২০১২ সনের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে নৌরুটটি বন্ধের আহবান জানায়। কিন্তু কেউ কারো কথা রাখেনি। বনের ভেতর দিয়ে লাগাতার চলছে জলযান, পরিবহন করছে তেলসহ বনের জন্য বিপদজনক পণ্য। হঠাৎ ডুবছে আর ছড়িয়ে দিচ্ছে দু:সহ দূষণ।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ জলাভূমিসমূহই আজ আর আগের স্বপ্রতিবেশে নেই। নগরায়ণ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, দূষণ, উত্তরের ধনী দেশসমূহের মাত্রাহীন ভোগবিলাসিতার জীবন, জলবায়ু বিপর্যয়, আবহাওয়াচক্রে পরিবর্তন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের কাছ থেকে জলাভূমির অধিকার কেড়ে নেওয়া, জলাভূমিনির্ভর ঐতিহাসিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া, প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, রাষ্ট্রীয় অবহেলা, প্রভাবশালীদের জবরদখল, গতিপথ পরিবর্তন, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনশীলতা, ঋতুচক্রে পরিবর্তন, জলাভূমির একতরফা বাণিজ্যিক ব্যবহার, বহুজাতিক খনন, অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এইরকমের নানান প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণ সরাসরি জলাভূমির স্থানিক চরিত্র এবং জলাভূমিনির্ভর জনগণের জীবনযাপনে এনেছে আমূল পরিবর্তন। রামসার সম্মেলনের পর জলাভূমি নিয়ে বৈশ্বিক মনোযোগ কিছুটা বাড়লেও আমরা এখনও পর্যন্ত জলাভূমি সংক্রান্ত কোনো সমন্বিত সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় সাড়া দেখতে পাইনি।
জলাভূমিকে হলো কোনো দেশের প্রাণ-আধার। দেশের হাওর-বিল- বাওড় থেকে শুরু করে নদ-নদী সবক্ষেত্রেই একই সহিংস উন্নয়ন জবরদস্তি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ বলেছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, জলাধার হিসেবে চিিহ্নত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। জলাভূমি নিজের জান দিয়ে দূর্যোগ থেকে দেশকে বাঁচায়। জলোচ্ছা¦স, বন্যা, পাহাড়ি ঢল, খরা, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়। জলাভূমি মানুষসহ সকল প্রাণসত্তার খাদ্য ও আশ্রয়স্থল। জলাভূমি জীবন ও জীবিকার ব্যাকরণ অবিন্যস্ত রাখে। নানান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দূর্বিপাকেও দেশের জলাভূমিরাই বাঁচিয়েছে পেট ও পিঠ। জলাভূমি সাংস্কৃতিক শক্তি সমুন্নত রাখে। সহিংসতার ক্ষত ও আঘাত থেকে প্রজন্মকে সুরক্ষা দেয়। জলাভূমি ছাড়া আমরা বাঁচবো না। কোনোভাবেই নয়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ জলাভূমি বিষয়ে কতটুকু আন্তরিক এবং জলাভূমি বিষয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শন কী ধরণের তা প্রথমেই পরিস্কার করা দরকার। বাংলাদেশের সকল ধরণের জলাভূমির বৈশিষ্ট্য, বর্তমান অবস্থা, সংকট, উত্তরণসহ জাতীয় জলাভূমি জনদলিল তৈরি জরুরি। জলাভূমি সংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, নীতি ও ঘোষণাসমূহের পাবলিক বিশ্লেষণ জরুরি। জলাভূমি সংক্রান্ত সকল রাষ্ট্রীয় প্রকল্প প্রণয়ন ও পরিকল্পনায় জলাভূমিনির্ভর স্থানীয় জনগণের সার্বিক সমন্বয় দরকার।
গবেষক ও লেখক। [email protected]