মিশ্র ফসল চাষ ও জৈব কৃষি চর্চা
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
“মানুষ যেমন এ্যানটিবায়েটিক ঔষধ খেলে সাময়িকভাবে তাদের রোগ ভালো হয়, কিন্তু শরীর দুর্বল এবং শরীরের অনেক ধরনের উপকারী উপাদানও নষ্ট করে, আরও রোগ আসার পথ তৈরী করে। ঠিক তেমনি ফসলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করার ফলে রোগ ধরতেই থাকে। একটা ভালো হয়তো আরেকটা রোগ ধরে।” কথাগুলো বলেছেন রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের বড়গাছি গ্রামের কৃষক মো. জুয়েল মিয়া (৩৯)।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অন্যতম কৃষি অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয় বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমের বরেন্দ্র অঞ্চলকে। কিন্তু কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ঘরে তোলার আগে কতো ধরনের উপদ্রপ সহ্য করতে হয় তার কোন ইয়ত্তা নেই। একদিকে নানামূখী উন্নয়নের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া লোপ এবং মাঠে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের আঞ্চলিক অভিঘাত কৃষককে করছে নানাভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু এর পরেও থেমে নেই কৃষক। নানা কৌশল অবলম্বন ও কঠোর পরিশ্রম করে সোনা ফলান তাঁরা।
এই প্রসঙ্গে পবা উপজেলা দর্শন পাড়ার কৃষক আলম (৫৫) বলেন, “অনেক ফসল করে দেখলাম, বাবুরা বুদ্ধি দেয় কীটনাশক ছিটানোর, রাসায়নিক সারও দেই খুব করে, কিন্তু দিনে দিনে ফসলে রোগ বেড়েই চলেছে।” তিনি আরো বলেন, “অবশেষে নিজের নিয়মটাই প্রয়োগ করেই বেশি সফলতা পাই। জমিতে বেশি করে জৈবসার দিলে রোগ পোকা কম লাগে। একই সাথে বৈরী আবহাওয়াও সহ্য করতে পারে।” অন্যদিকে বড়গাছী ইউনিয়নের নারী কৃষক মনিরা বেগম (৪৬) বলেন, “এই বছর শীত কম হওয়ায় রবিশস্যের মধ্যে বেশি রোগবালাই ধরছে। এবার মসুর, গম, আলূতে হয়তো আশানুরূপ ফলন পাবো না আমরা।” তিনি বলেন, “যারা তুলনামূলক জমিতে বেশি গোবর সার দিয়েছে তাদের ফসলে রোগ বালাই কম এবং ফসলের চেহেরাও অনেক ভালো হয়েছে।”
কৃষকদের সাথে মতবিনিময় এবং আলোচনায় জানা যায়, মিশ্র ফসল চাষ করলে ফসলে রোগবালাই আর পোকার আক্রমণ কম হয়। রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক মো. রহিম উদ্দিন এই বিষয়ে বলেন, “আগে জমিতে মিশ্র ফসলের চাষ হতো বেশি, এতো রোগ পোকা লাগতো না ফসলে। আর আমরা জমিতে গোবর সার বেশি দিতাম। ফসলও ভালো হতো।”
চলতি রবি মৌসুমে বড়গাছী ইউনিয়নের কৃষকগণ মিশ ফসলের পরীক্ষামূলক চাষও শুরু করেছেন। পরীক্ষামূলক রবিশস্যের চাষ পরিচালনাকারী কৃষক মো. জুয়েল মিয়া বলেন, “আমাদের ফসলে এখনো কোন ধরনের পোকা লাগেনি, আমরা জমিতে কোন ধরনের রাসায়নিক সার বা বিষও দেইনি। শুধু গোবর, কুইককম্পোস্ট, কেঁচো কম্পোস্ট, বোর্দমিক্সার দিয়েছি।” সরেজমিনে দেখা যায়, তাঁর জমিতে কোন ধরনের রোগ পোকার আক্রমণ হয়নি এবং ফসল দেখতেও অনেক সুন্দর, সুস্থ ও সবল। তিনি আরো বলেন, “চলতি বছর শীতের ব্যাপ্তিকাল কমে গেছে, শীতের তীব্রতা কম, তারপরও ফসল অনেক ভালো হয়েছে।”
শরীর সুস্থ এবং সবল থাকলে, দেহ প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পেলে মানুষ যেমন অপুষ্টির শিকার হয় না। রোগাক্রান্ত হয়না। সহজে রোগ ধরেনা। বৈরী কিছুকেও জয় করে। ঠিক তেমনি ফসলও তার প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পেলে যেকোন রোগ পোকা এবং বৈরী আবহাওয়া সহ্য করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কৃষি অভিযোজন উদ্যোগে তাই কৃষকের অভিজ্ঞতাগুলো বেশি করে কাজে লাগানো উচিত। একই সাথে পরিবেশবান্ধব জৈব কৃষি চর্চা শুধু প্রচারে না রেখে সেটা প্রসার ও প্রয়োগেও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।