খরা ও করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে কাজলি হাঁসদার অনন্য উদ্যোগ
রাজশাহী থেকে রিনা টুডু ও শহিদুল ইসলাম
একটি মহাক্রান্তিকাল সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। একদিকে মহামারি করোনা (কোভিড-১৯) অন্যদিকে খরার কারণে ফসলহানিসহ খাবার পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে। এর মধ্যেও বেঁচে থাকতে নিজের জীবন জীবিকার জন্য লড়াই করে চলেছে মানুষ। বিশেষ করে গ্রামের উৎপাদনমূখী সোনার মানুষগুলো নিজের আশ পাশের সবকিছু সর্বস্ব দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
তেমনি একজন খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা মাহালি পাড়ার সোনার মানুষ কাজলি হাঁসদা (৩১)। বিয়ে হয়েছিলো সেই পাঁচ বছর আগে। সংসারে অভাব অনটন আর স্বামীর নিজের থাকার বাড়ি ভিটেটুকু না থাকার কারণে বিগত তিন বছর থেকে আশ্রয় নিয়েছেন নিজের বাবার বাড়িতে। নিজের স্বামী এবং একজন তিন বছরের সন্তানসহ তাঁর বাবা মায়ের পরিবারে এখন দশজন সদস্য। বাবার থাকার এক টুকরো জমি থাকায় সেখানেই থাকেন সবাই। মা প্যারালাইস্ড হয়ে শয্যাশায়ী। নিজের স্বামী, বাবা এবং এক ভাই বাঁশের কাজ করেন। বিশাল এই পরিবার চলে এই দুজনের আয়েই। কিন্তু করোনা এসে তাও বন্ধ। লকডাউন আর করোনার কারণে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র গ্রামে বা হাটে বিক্রিও করতে পারেন না। এর মধ্যেও বিশাল এই সংসারের সদস্যদের ভাত জোটে তো তরকারি/সবজি জোটেনা।
এমন অবস্থায় কাজলি চিন্তা করেন নিজেরা যদি সবজিটুকু উৎপাদন করা যেতো; অনেক টাকা সাশ্রয় হতো। কিন্তু তাঁর নিজের কোন জমি নেই। আশ পাশে খুঁজতে থাকেন। যদি এক টুকরো জমি পাওয়া যেতো! এরই মধ্যে পাড়ার পাশেই একজন প্রতিবেশির প্রায় এক কাঠা জমি পরিত্যক্ত থাকতে দেখেন। কাজলি হাঁসদা কথা বলেন সেই জমির মালিক মো: আবিরের সাথে। বলেন, ‘পড়েই তো আছে, জমিটুকু আমাকে সবজি চাষ করতে দেন দাদা।’ কথা শোনামাত্র কোন শর্তহীনভাবে সুহৃদ মো: আবির জমিটি চাষ করতে দেন কাজলিকে। কাজলি নিজের প্রচেষ্টটায় জমি তৈরি করে সেখানে সবজি চাষের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাঁর কাছে ছিলোনা কোন সবজির বীজ। এই গ্রামে নানা কাজে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক। বারসিক স্থানীয় জাতের সবজি বীজসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনিময়ে সহায়তা এবং লিংকেজ করে দিতে সহযোগিতা করে। এভাবেই কাজলি গ্রামের আরেকজনের কাছে বীজ পেয়ে যান। তিনি তার জমিতে প্রথম পর্যায়ে ঢেঁড়শ, পুঁইশাক, কাঠুয়া ডাটা, পাট শাক, সবুজ শাক করার পরিকল্পনা করেন।
এতো কিছু পরিকল্পনা করার পরও কাজলির চিন্তার যেন শেষ হয় না। সবজি চাষ করতে পানি পাবে কোথায়? কারণ তার এই এলাকাটিতে খাবার পানি পাওয়াই মুসকিল হয়ে যায়। আবার সবজি চাষে পানি পাবে কোথায়। তিনি বুদ্ধি করেন পাশের পুকুর থেকে পানি এনে দিবেন। কিন্তু সেখানেও বাঁধা। কারণ পুকুর লিজ গ্রহণকারীরা পানি তুলতে দেওয়া হয় না। তাই তিনি বুদ্ধি করেন বাড়িতে যেসকল পানি ব্যবহার করা হয় সেগুলোতো এমনিতেই নষ্ট হয়। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন- বাড়িরে পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে লাইন করে দিবেন, যেখানে নিজেদের গোসলের পানিসহ অন্যান্য ব্যবহার করা পানি গিয়ে জমা হবে, সেই পানি সবজি ক্ষেতে দিবেন। তিনি সেভাবেই একটি গর্ত খুঁড়ে বাড়ির সকলের ব্যবহৃত পানি সবজি খেতে ব্যবহার করেন।
কাজলি এভাবেই পানি রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে সবজির খেতে পানি সরবরাহ করে থাকেন। মাঝে মাঝে অনেক কটু কথা শোনার পরও পুকুর থেকেও কিছু পানি এনে সবজি ক্ষেতে দেন। তার বাগান এখন সবুজের ভরে গেছে। প্রতিদিন নিজের পরিবারের জন্য সবজি এখান থেকেই সংগ্রহ করেন। অতিরিক্ত সবজি তিনি বিক্রি করেন পাড়া প্রতিবেশিদের কাছে। তিনি সবজি চাষে কোন ধরনের রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। বাড়ির আশপাশে, রাস্তা থেকে গরুর গোবর কুড়ে এনে তিনি সেই গোবর সার করে তার সবজি বাগানে দেন। এর ফলে তার সবজির চাহিদাও বেশি।
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের কাজলি পানির পুনঃব্যবহার করে সবজি চাষ করা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। এভাবে খরা এবং পানি সংকটেও যে নিজেদের জন্য সবজি চাষ করা যায় তা একটি দৃষ্টান্ত।
এই প্রসঙ্গে কাজলি হাঁসদা বলেন, ‘প্রতিদিন তো কমপক্ষে পরিবারর জন্য ৫০ টাকার সবজি লাগতো। এখন সেটা কিনতে হয় না। বরং নিজেরা খেয়ে যেগুলো বেশি হয় তা বিক্রি করে সংসারের উপকারে আসছে।’ তিনি জানান, এ পর্যন্ত তিনি দুই হাজার টাকার বেশি সবজি বিক্রি করেছেন। সেই জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত তার পরিবারের সকল সবজি তার বাগান থেকেই সরবরাহ করা হয়। তিনি মনে করেন এর ফলে তার পরিবার সবজি কেনাবাবদ দশ থেকে বারো হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে। পরিবারের সবজির চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্যে বাধাইড়-মন্ডুমালা এলাকাটি একটি পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। গত বছরের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। দিনে দিনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাবার কারণে খাবার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলের মধ্য সব থেকে পানির কষ্ট বা পানির সংকট বেশি দেখা গেছে এই এলাকাটিতে। পানি সংকটময় এলাকায় কাজলি হাঁসদার পানির পূনঃব্যবহার করে সবজি চাষ একটি অন্য দৃষ্টান্ত বলা যায়। এভাবে বাড়ি বাড়ি পানি সংরক্ষণ করে সবজি চাষ করে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির অপচয়রোধ করা সম্ভব।