উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় খরাসহনশীল ফসল চিনা’র চাষ বাড়ছে
রাজশাহী থেকে ব্রজেন্দ্রনাথ
জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিপরিবেশের বদল হওয়ায় ফসলের মাঠ থেকে শস্য-ফসলের জাতবৈচিত্র্য কমেছে এটি যেমন সত্য তেমনি একই কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে অঞ্চলবিশেষে শুরু হয়েছে অনেক লুপ্তপ্রায় ফসলের চাষাবাদ। চিনা (Panicum miliaceum) এমনই একটি ফসল, যা খরাপ্রবণ উচ্চবরেন্দ্র কৃষিপরিবেশ অঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের পূর্ব নেজামপুর গ্রামের আটবিঘা জমিতে এ বছর কৃষকরা চাষাবাদ করছেন।
বরেন্দ্র এলাকার উচু নিচু জমিতে কৃষকরা বোরো চাষে পানি সেচের অতিরিক্ত খরচ কমাতে মসুর, ছোলা ও সরিষা চাষ করে থাকেন। এখানকার অনেক জমি মসুর চাষের পর বর্ষার আগ পর্যন্ত পতিত অবস্থায় থাকে। সেচ খরচ ও পতিত জমি কাজে লাগাতে কৃষকরা বহু বছর আগে খরাসহনশীল চিনা চাষ করতেন। তবে গভীর নলকূপের মাধমে সেচ চালু হওয়ার পর চাষের প্রবণতা কমে যায়। তবে এবার সেচ খরচ ও পতিত জমি কাজে লাগাতে কৃষকরা পুনরায় এ চিনা ফসল চাষ করছেন। প্রতিবছরই বাড়ছে এ চাষ।
পূর্ব নেজামপুর গ্রামে চিনা চাষের পুনঃপ্রবর্তন করেন মো. এনামুল হক (৩৭)। তিনি একই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় চিনার চাষাবাদ দেখে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি জানান, চিনা দীর্ঘ সময়ের জন্য খরা সহ্য না করতে পারলেও সমস্ত দানাদার ফসলের মধ্যে চিনাতে পানির চাহিদা সবচেয়ে কম। যে কোনো ধরনের মাটিতেই চিনা চাষ করা যায়। আমন ধান কাটার পর রবি মৌসুমে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসের শুরুতে জমি ভালোভাবে চাষ করে বীজ ছিটিয়ে বপন করে চিনা চাষ করলে সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়া যায়। আবার গ্রীষ্ম মৌসুমে ফাল্গুন-চৈত্র মাসের শেষে জমি থেকে মসুর সংগ্রহের পরে সেই মসুরের জমিতেও চিনা চাষ করা যায়। জমিতে রস থাকলে চাষ ছাড়াই বীজ ছিটিয়ে বপন করা সম্ভব। আর জমিতে আর্দ্রতা না থাকলে জমিটি পানি দিয়ে ৩-৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে পানি বের করে দিয়ে পরিমিত আর্দ্রতা এনে বীজ বপন করা যায়। বীজ বপনের সাত দিনের মধ্যে চারা গজালে ২০-২৫ দিন পরে সেচ দিতে হয়। গম চাষের মত ১-২ বার সেচই চিনার জন্য যথেষ্ট। বপন থেকে শুরু করে ৭০-৮০ দিনের মধ্যেই চিনা সংগ্রহের উপযোগী হয়।
মোঃ এনামুল হক জানান, মসুর চাষের পর জমি পতিত না রেখে চিনা চাষ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব। মসুর সংগ্রহের পর জমিতে আগাছা বেশি না থাকলে সরাসরি চিনার বীজ ছিটিয়ে বপন করা যায়। তবে অধিক ফলনের জন্য কোনো কোনো কৃষক জমি চাষ করে সারি পদ্ধতিতে ও চিনার বীজ বপন করেন। বিঘাপ্রতি ২.৫ কেজি হারে বীজ বপন ও আনুষাঙ্গিক প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ করে প্রতি বিঘায় ৮-৯ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব, যা আনুমনিক ২ হাজার চারশ’ টাকা দরে বিক্রি করে ১৬ হাজার ৬শ’ টাকা লাভ করা যায়। তিনি জানান, বরেন্দ্র এলাকায় বর্তমানে সেচ পানির দাম বাড়ায় অনেক কৃষক চিনা চাষে অগ্রহী হয়েছেন। এই কারণে আগামী বছরগুলোতে এই এলাকায় চিনা চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে তিনি মনে করেন। চিনা দিয়ে পায়েস, নাড়ু,– মোয়া, খিচুরি, পিঠা নানা বৈচিত্র্যময় খাবার তৈরি করা যায় এবং পাখির খাবার হিসেবে চিনার ব্যবহার রয়েছে।
উল্লেখ্য, খরাপ্রবণ উচ্চবরেন্দ্র এলাকায় বারসিক স্থানীয় এলাকার পরিবেশ-প্রকৃতি, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, লোকায়তজ্ঞান ও প্রাকৃতিক সম্পদে প্রান্তিক মানুষের প্রবেশাধিকার নিয়ে ২০১০ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ও রাজশাহী জেলার, গোদাগাড়ি, পবা ও তানোর উপজেলায় নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।