মাটির নায়ক কৃষক মোশাররফ হোসেন
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
ব্রহ্মপুত্র নদের পুত্রপাড়। ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দার উপজেলার সিংড়ামুহী বিলের পাড়ে তারাটি গ্রামের এক মাটির নায়ক কৃষক গবেষক মোশাররফ হোসেন। ছোটকাল থেকেই বাবার সাথে কৃষি কাজ করতে করতে বড় হয়ে উঠেছেন। নদের পলি পড়া মাটির ধানের ভাত খেয়ে, সিংড়ামুহী বিলের মাছ খেয়ে, শাপলা শালুক কুড়িয়ে, বাউল, জারি, পালাগান শুনে শুনে প্রকৃতি থেকে শিখে শিখে সাজিয়েছেন জীবনের গল্প। কৃষক মোশাররফের জন্ম ১৯৬০ সালে তারাটি গ্রামে। পড়াশুনা করার সুযোগ পাননি। কৃষিকাজ, গরুর রাখাল, ধান চাষ, সবজি চাষ করে প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতি থেকে শিখে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। কৃষিকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন প্রকৃতিকে।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/10/Musarfof1.jpg)
উদ্যোগী কৃষক মোশাররফ হোসেন ২০১৪ সালে কামারিয়া ইউনিয়নের সাধুপাড়া গ্রামে জনউন্নয়ন কেন্দ্রে প্রাণবৈচিত্র্যমেলায় অংশগ্রহণ করেন। এ সময় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন তিনি। পরিদর্শনে তিনি কৃষক সংগঠনের জাতগবেষণা, সাধুপাড়া কৃষক সংগঠনের উদ্যোগ, বীজঘর, ধানজাত উন্নয়ন কার্যক্রম দেখে উৎসাহিত হন। তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন নিজের গ্রামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার। গ্রামের কৃষকদেরকে নিয়ে গ্রামের পাশের প্রিয় বিলের নামে গড়ে তোলেন সিংড়মুহি কৃষক সংগঠন। সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে তিনি নিরাপদ বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন, মৌমাছি চাষ, জৈবকৃষি চর্চা, বীজঘর তৈরি, ধানের জাত উন্নয়ন কার্যক্রমসহ প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন একজন মাটির মানুষ হয়ে।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে তিনি নিজ বাড়িকে একটি পুষ্টিবাড়ি হিসেবে গড়ে তোলেছেন। সারাবছরই তিনি মৌসুমভিত্তিক সবজি চাষ করেন। নিজ চাহিদা পুরণ করে বাজারে বিক্রি করেন। কৃষক মোশাররফ জানান, তাঁর সবজির দাম বাজারে অন্যান্য সবজির চেয়ে আলাদা। বিষমুক্ত এই সবজির বাজারে অনেক চাহিদা। বাড়ি থেকেও অনেকে কিনে নিয়ে যান।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/10/Musarof.jpg)
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য তিনি রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে নিজের তৈরি কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করেন। নিজ বাড়িতে হাউজ করে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি ও ব্যবহার করছেন। তিনি এ পর্যন্ত ২৭ জন সমমনা কৃষককে কেঁচো দিয়ে পরামর্শ দিয়ে ও হাউজ তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।
কৃষক মোশাররফ হোসেন বাজার থেকে বীজ সংগ্রহ করেন না। তিনি নিজ বাড়িতে বীজসংগ্রহ করেন। নিজে রোপণ করেন এবং অন্য কৃষককে সহযোগিতা করেন। তার বাড়ি পরিদর্শন করে দেখা যায় ২৯ জাতে বীজ সংগ্রহে রেখেছেন। তিনি ডাটা, লালশাক, লাউ, মিষ্টিলাউ, সীম, পেয়াজ, রশুন, ধনিয়া, মটরশুটি, ঢেরস, মরিচ, বেগুন, চুকাই, পেঁপে, কচু, মুখি, মশুরী, মাসকালাই, তিল, বাঙ্গি, আদা,হলুদ, গোলআলু, ধান, সুপারি, নিম, বরবটি,গুয়ামরি, সরিষা ইত্যাদি চাষ করেন। এসব সবজির বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন এবং গ্রামের কৃষক কৃষানিদেরকে বিনা পয়সায় প্রদান করেন। এসব বীজ ব্যবস্থাপনার জন্য তিনি একটি বীজঘর গড়ে তুলেছেন।
তিনি গ্রামের ও আশেপাশের কৃষকদেরকে সংগঠিত করে সিংড়মুহী কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সংগঠনের সদস্যরা গ্রামে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা সমাধানে, জৈবকৃষি চর্চা, বীজসংগ্রহ ও বাজার নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। উক্ত কাজে সহযোগিতা করছেন মাটি ও মানুষের কৃষক নেতা মোশাররফ হোসেন।
তাঁর আগ্রহ থেকেই কিশোরগঞ্জ বিআইএ থেকে মৌচাষের উপর একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ২০১১। তারপর থেকেই বাড়িতে নিজ উদ্যোগে মৌচাষ শুরু করেন। এখন তাঁর বাড়িতে আছে চারটি বক্স। যেখানে তিনি মধু উৎপাদন করেন। বিশুদ্ধ মধু তিনি প্রতিকেজি বিক্রি করেন এক হাজার টাকা দরে। অনেকদূর থেকে মানুষ এসে বিশুদ্ধ মধু সংগ্রহ করেন। তিনি গ্রামের আরো পাঁচজনকে মৌচাষের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/10/227479455_4044958085632272_8719174187052635128_n-806x1024.jpg)
তিনি একটি নতুন জাতের ধান পাওয়ার জন্য দুটি ধানের ক্রসিং করে একটি নতুন জাত তৈরি করেছেন, যা গত পাঁচ বছর ধরে চাষ করে যাচ্ছেন। নতুন নতুন চিন্তা, আগ্রহ, উদ্যোগ কৃষক মোশাররফ হোসেনকে আকৃষ্ট করে। তিনি নতুন কিছু পেলেই ছুটে যান জানার জন্য, সংগ্রহের জন্য।
কৃষক কৃষক কাজের পদ্ধতি সম্প্রসারণ, কৃষককে কাজের সাথে যুক্ত করা, সংগঠন গড়ে তোলার জন্য তারাকান্দা উপজেলায় ১৯টি গ্রামের কৃষক ও নানা পেশার মানুষের সাথে কৃষক মোশাররফ হোসেন কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জননেতৃত্বে উন্নয়ন কার্যক্রমকে সম্প্রসারণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি মাটির মানুষ, কৃষকের বন্ধু।