কৃষকের ঘরে নবান্নের আনন্দ
ঘিওর, মানিকগঞ্জ থেকে সুবীর কুমার সরকার
শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের সাথে নিরবে এ দেশে নবান্নের আনন্দের সুবাতাসও চলে এসেছে। বাংলা মাসের কার্তিক ও অগ্রহায়ণ দুই মাস কৃষকের মাঠে সোনালি ধানের হাসি দেখা যায়। আর সকাল সন্ধায় হেমন্তের মৃদ মৃদ কুয়াশার বিন্দুতে নতুন ধানে কৃষকের ঘরে ঘরে আনন্দের ধুম পড়ে নবান্নের সময়। কৃষকের মুখেও এসময় হাসি ফোটে। নতুন স্বপ্ন রচনা করেন।
এরকম নতুন স্বপ্ন নিয়ে মানিকগঞ্জে ঘিওর উপজেলার নালী ইউনিয়নের কুন্দরিয়া ও হেলাচিয়া গ্রামের কৃষকের ঘরে নতুন ধান তোলার সাথে সাথে কৃষাণীদের মাঝে শুরু হয় নবান্নের উৎসব ও আনন্দ। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে প্রাচীনকাল থেকেই নবান্নের উৎসব পালন করে আসছে। কালের বিবর্তনে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও নবান্নের আনন্দ পালন করতে বাকি রাখেন না গ্রামের কৃষক কৃষাণীরা।
নবান্নের উৎসব শুরু হয় আমন মৌসুমের ধান কাটার দিন থেকেই। ঐ দিন কৃষাণীরা বাড়ির ঘর দুয়ার গোবর দিয়ে নেপে পুঁেচ পরিপাটি করে বাড়িতে নতুন ধান আনা শুরু করেন। এরপর মলন দেয়া, ধান উড়ানো, ধান মাচায় তোলা, খাবারের জন্য ধান সেদ্ধ করা, এরপর ধান ভাঙিয়ে চাল তৈরি করে নিজেরা ও পাড়া প্রতিবেশীদের দাওয়াত করে খাওয়ান। বাড়ির মেয়ে ও জামাইকে নতুন ধানের পিঠা খাওয়াতে দাওয়াত করে নিয়ে এসে পিঠা –পায়েস তৈরির মধ্যে দিয়ে কৃষকেরা ঘরে ঘরে নবান্নর উৎসব পালন করেন। কৃষকদের বাড়িতে রাতে বসে গল্প ও গানের আসর। এ ছাড়া এ সময় চলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা যেমন দাড়িয়া বাঁধা, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কানামাছি, মোরগ লড়াইসহ হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলা।
কুন্দরিয়া ও হেলাচিয়া গ্রামের মাঠে বাপ দাদার আমল থেকেই চলে আসছে আমন জাতের ধান ও খেশারি চাষ। এই দু’ফসলি দিয়ে কৃষকরা চালাছেন তাদের নিত্যদিনের কাজ কর্মের সংসার। এই প্রসঙ্গে কুন্দরিয়া গ্রামের কৃষক সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘অতীতে কুন্দরিয়ার মাঠে ৫-৬টি জাতের আমন ধান চাষ হতো আর আউশের ছিল ২-৩টি জাত। গত কয়েক বছর যাবৎ হঠাৎ বন্যা হওয়ার জন্য আমনের দিঘা ও ভাওয়াইল্যা তেমন ভালো হয়নি। ১৯৯৮ সালের বন্যার এখানকার জুলদিঘা, মুল্ল্যাদিঘা, ভাওয়াইল্যার আসল জাত হারিয়ে গেছে। এখন ফরিদপুরের জাতের দিঘা চাষ হচ্ছে। আমনের জাতের ধান গাংডুবী, ঠাটাংগা , দিয়াইল , নিমতা গ্রামে কিছুটা দেখা যায় নিচু জমি এবং যে খানে জল হয় তেমন জায়গায় ছাড়া এ জাত চাষ সম্ভব নয়।’
আরেক কৃষক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জমি রাসায়নিক সারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই জমির প্রাণ বাঁচাতে আমরা এখনো আমন জাতের ধান ও খেশারির চাষ করে জমির প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।’ আমনের নাড়া ও খেশারির ভুষি পচলে তা থেকে থেকে জৈব সার তৈরি হয়ে জমি বেঁচে থাকে।’
হেলাচিয়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক হাশেম আলী (৭৭) বলেন, ‘আমনের বরণ, বাড়ইঝাক, কইতুরমনি, দিঘা, ভাওয়াইল্যা ধানের ভাত খেলে অসুখ বিসুখ কম হয়। বর্তমানে ইরি ধান এলো। সাথে সাথে মানুষের দেহে অসুখ বিসুখ দেখা দিল। মানুষ বেশি ধান উৎপাদনের জন্য সার, বিষ বেশি বেশি জমিতে দিয়ে থাকে। এতে জমির উবর্রাশক্তি কমে যাচ্ছে ও মানুষের দেহে অসুখ বিসুখ বেশি দেখা দিচ্ছে।