সকল ভাঙনের মধ্যে সবাই মিলে ভালো আছি

মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে রিনা আক্তার
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই তো মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হয়। একটি পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোনকে নিয়ে যেমন একক পরিবার গঠিত হয়, তেমনিভাবে দাদা, দাদী, চাচা-চাচি, ফুপুদের নিয়ে যৌথ পরিবার গঠিত হয়। একটি সময় ছিল আমাদের পরিবারের সবার সাথে সম্পর্কগুলো ছিল আনন্দময়। কিন্তু বর্তমানে যে যুগ চলে এসেছে আমাদের পরিবারের সম্পর্কগুলো আর আগের জায়গায় নেই; ভঙ্গুর হয়ে গেছে। একটি রাত আর দিন পার্থক্য করলে যেমন হয় তেমনি নানান ভুল-ভ্রান্তির কারণে পরিবারের শান্তি নষ্ট হচ্ছে। সবাই চায় একক পরিবার গড়তে। কিন্তু বর্তমানে সবাই একক পরিবারের দিকে ঝুকলেও ফালানি রানী সরকারের পরিবারটি যেন সকলের জন্য উদাহরণস্বরুপ। আজকে তাই তার সেই যৌথ পরিবারের গল্পই এখানে তুলে ধরবো।

মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর পৌরসভার আঙ্গারিয়া গ্রামে সামাজিক বাড়ি হিসেবে পরিচিত ফালানি সরকারের বাড়ি। তিনি দশ সন্তানের জননী হলেও বর্তমানে তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যার জননী।বয়স তার একশ ছুই ছুই। তিনি প্রায় ২০ বছর আগে তার স্বামীকে হারিয়েছেন। বড় ছেলের নাম ধনন্ঞ্জয় সরকার (৬৫), মেজো ছেলের নাম মননঞ্জয় সরকার (৫৮), ছোট ছেলের নাম সঞ্জয় সরকার (৪০) এবং মেয়ের নাম কল্পনা সরকার (৫১)। তার পরিবারে ছেলে-মেয়ে, বউ এবং নাতি-নাতনি নিয়ে সদস্য সংখ্যা ১৭ জন, তার মধ্যে ২ নাতনীকে তিনি বিয়ে দিয়েছেন।
ফালানির বাড়িতে বিশাল একটি উঠান রয়েছে, আশে-পাশের বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, ফসল মাড়াই, শুকানোসহ বিকেল বেলা বাচ্চাদের খেলাধুলায় পুরো বাড়ি মুখরিত হয়ে ওঠে। তাঁর সেই উঠানে বিভিন্ন আলোচনা সভার আয়োজনের পাশাপাশি নবীন-প্রবীণদের সাথে নিয়ে গল্পের আসরের আয়োজন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক।


কথায় আছে ‘‘যত মানুষ তত কাজ, নাই মানুষ নাই কাজ’’। একটি পরিবারে সবাই যদি একসাথে থাকে তাহলে সন্তানকে ভালো মতো লালন-পালন করা যায়, বাইরে গিয়ে সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয় না। একে অপরের বিপদ-আপদে এগিয়ে আসতে পারে। ছোট বাচ্চারা তাদের দাদা-দাদি বা নানা-নানির সান্নিধ্য পায়। তারা তাদের কাছ থেকে রূপকথার গল্প, অতীত জীবন প্রণালী সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের মানসিক গঠন ও বেড়ে ওঠায় যৌথ পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধুমাত্র শিশুদের ক্ষেত্রেই নয়, যৌথ পরিবারে সদস্যদের ভালো বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতাও আসে, একেকজন একেকভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। সেইসাথে কোন বৃদ্ধ মা-বাবাকে যেতে হবে না বৃদ্ধাশ্রমে।


ফালানি সরকার বলেন, ‘‘আমার পরিবারের সবাই যখন একসাথে খাবার খেতে বসে তখন সে দৃশ্যের ব্যাখ্যা দেয়া আমার কাছে অস¤ভব। আর পারিবারিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তারা সকলের মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়। আর কাজটি সুন্দরভাবে শেষ করে। তার পারিবারিক সকল বিষয়ে তার মতামতকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ কথায় আছে, ‘‘পুরান চাল ভাতে বাড়ে’’। তার পারিবারিক আয়োজনে বিয়ে, পুজা পার্বণ, পৌষের পিঠাপুলি, চৈত্র সংক্রান্তি প্রভৃতিতে তারা সকলে মিলে মিশে কাজ করেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘তার পরিবারে এখনো বাড়িতেই ঢেঁকিতে চাল কুটে। হাতের তৈরি বিভিন্ন রকমারি পিঠা তৈরি করেন, যা এখন প্রায় কমে গেছে। সবাই আলাদা আলাদা থাকার কারণে তারা এই আয়োজন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পরিবারের আসল আনন্দ তারা পায় কোথায়? প্রকৃত আনন্দ তো সকলে মিলে একসাথে থাকার মধ্যে।’


তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘একা থাকা এবং একা খাওয়ার মাঝে কোন সুখ নেই। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে মিলেমিশে থাকার মাঝে রয়েছে অপার সুখ। আগেকার মতো সবাই যদি সকল হিংসা বিদ্বেষ ভুলে একসাথে থাকতো তাহলে যৌথ পরিবারগুলো টিকে থাকতো। এখনো সময় আছে সবাই মিলে সেই যৌথ পরিবারগুলোকে সুরক্ষা করা।’

happy wheels 2

Comments