আশ্বিনা ডাওরে ডুবছে বরেন্দ্রভূমি
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
‘আমি বিগত ৩০ বছরে এমন আশ্বিনা ডাওর (একটানা বৃষ্টি) দেখিনি।’ আজ থেকে ৩০ বছর আগে এমন হয়েছিলো কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের মোঃ মূর্শেদ আলী (৫৯)। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভৌগলিক কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কম। তবে চলতি বছরের এ সময় এসে সে কথা যেন ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে। কারণ গতকাল রাত ১০.৩০ মিনিট থেকে বৃষ্টি শুরু শুরু হয়ে আজ এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বেলা ১.৩০ পর্যন্ত চলছে একটা বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই। প্রায় ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটা চলছে বৃষ্টি। এতে করে খা খা বরেন্দ্র ভূমিও যেন ডুবছে নি¤œাঞ্চলের মতো। চলতি বছেরে যেখানে বৃষ্টির অভাবে আমন ধান রোপণ সম্ভব হচ্ছিলো না সেখানে এই আশ্বিন মাসে এসে প্রতিটা ধানের জমিতেই কোমড় সমান পানি। এখানে উল্লেখ যে এই অঞ্চলের অধিকাংশ ধানের থোর হয়েছে (শীষ বের হওয়ার আগের মূহুর্ত)।
বরেন্দ্র অঞ্চলের জমির বেশিষ্ঠ হলো নিঁচু, মধ্যম ও উঁচু তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া, মোহর, যোগিশো, দুবইল, মন্ডুমালা, মাহালীপাড়া ঘুরে দেখা গেল নিঁচু জমির ধানগুলো ডুবে গিয়েছে, মধ্যম জমির ধানগুলো ডোবা ডোবা এবং উঁচু জমিতে থোর সমান পানি। এ বিষয়ে যোগিশো গ্রামের মিলন হালদা(৪৮) বলেন, “যে ধানগুলো থোর হয়েছে পানি নেমে গেলে তার তেমন ক্ষতি হবে না। তবে নিঁচু জমির ধানগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে কারণ এখান থেকে পানি নিষ্কাশন হয় দেরিতে।’ দুবইল গ্রাম ঘুরে দেখা গেল এ বিষয়ে কৃষকরা তেমন চিন্তা করছে না। কারণ এ গ্রামের অধিকাংশ জমির ধান থোর হয়েছে। আবার মোঃ খায়রুল আলম (৩৯) বলেন, “আমাদের প্রায় সকল জমি উঁচু হওয়ায় পানি নিষ্কাশন হয় তারাতারি।’
দুবইল গ্রাম থেকে ভিন্ন চিত্র তানোর উপজেলার হরিদেবপুর, হাতিশাইল, ধানতোর গ্রামগুলোর। কারণ এ গ্রামগুলোর অবস্থান শিবনদী ও বিলকুমারী বিলের পাশে এবং জমিগুলো নিঁচু প্রকৃতির। আর এই উপজেলার অধিকাংশ পানি এই গ্রামগুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শিব নদী ও বিলকুমারী বিলে চলে যায়। এ বিষয়ে হরিদেবপুর গ্রামের মোঃ আসরাফুল আলম বলেন, (৩৫) বলেন, “আমি একটানা এতা বৃষ্টি দেখিনি, আমাদের গ্রামের অধিকাংশ কৃষকের ধান পানির নিচে তলিয়ে আছে। পানি তারাতারি সরে না গেলে আমাদের অনেকক্ষতি হয়ে যাবে। গোকুর মোথুরা গ্রামটি একদন বিলকুমারী বিলের পাশে এই গ্রামের জিতেন্দ্রনাথ সূত্রধর (৬২) বলেন, “একটানা যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তাতে বিলপারের ধানগুলো ডুবে গেছে। কিছু ধান জেগে আছে তবে সব পানি নেমে আসলে সেগুলোও ডুবে যাবে।’ তিনে আরো বলেন, ‘আমার এক বিঘা আগুর ধান ছিলো গত ২-৪ দিন আগে শীষ বের হয়েছে তা এখন পানি নিচে আমার সে ধান নষ্ট হয়ে যাবে।
তানোর উপজেলার মন্ডুমালা এলাকা উঁচু প্রকৃতির সেখানকার অধিকাংশ জমির ধান থোর হয়েছে সে জমিগুলোতেও হাটু সমান পানি আবার কোন কোন জমিতে ধান ডুবে গিয়েছে। এ জমিগুলো তেমন একটা ক্ষতি হবে না। তবে মাহালপিাড়া গ্রামে ঘুরে দেখা গেল সবাই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ব্যস্ত। এ গ্রামে পানির চরম সংকট। এই গ্রামের ফুলমনি কিস্ক ু(৪৭) বলেন, “একটানা অনেক বৃষ্টি হচ্ছে আমরা চেষ্টা করছি এ পানিগুলো ধরে রাখার। অনেকদিন পর্যন্ত এ পানি ব্যবহার করা যাবে।’ এ চিত্র এ গ্রামের সকল বাড়ির যে যেখানে পারছে বৃষ্টির পরিষ্কার পানি সংরক্ষন করে রাখছে রান্না ও দৈন্দিন ব্যবহারের জন্য।
অতি বৃষ্টির ফলে এ অঞ্চলের অধিকাংশ পুকুর ভেসে গিয়ে মাছগুলো বের হয়ে গিয়েছে। আবার এখন সকল জায়গায় পানি জমেছে। যোগিশো গ্রামের মোঃ আব্দুল আলিমের (৪০) বাগানে জাল দিয়ে অনেকে মাছ ধরছে। এখানে এ সময় অন্য বছরে পানি থাকেই না। মোঃ আব্দুল আলিমের ২টি পুকুর ভেসে গিয়ে মাছগুলো বের হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “গত রাত থেকে যেভাবে বৃষ্টি শুরু হয় আমি সময়ই পায়নি পুকুর ঘিরে দেওয়ার। আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।’ এই গ্রামেরই মনা হাসদা (৩৭) গত বছর রাস্তার পাশে বাড়ি নির্মাণ করেন অতি বৃষ্টির ফলে তাঁর বাড়িতে এ কোমর পানি উঠেছে। বাড়ির সকল জিনিস ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, “আমাদের এলাকায় এমন পানি দেখিনি এর আগে। বাড়িতে কবে আসতে পারব জানি না।’
একটানা এই আশ্বিনা ডাওর সম্পর্কে তানোর উপজেলার জাতীয় পদক প্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ (৬১) বলেন, “অনেক বছর পর আমাদের অঞ্চলে এমন বৃষ্টি দেখলাম। এর ফলে চলতি আমন ধানে রোগ ও পোকার আক্রমণ বাড়বে। সঠিক ব্যবস্থাপনা না করলে ধানের ক্ষতি হয়ে যাবে।’ বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকের বর্তমান সভাপতি মোঃ জায়দুল আলম (৫৬) বলেন, “অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়। একটানা এই বৃষ্টিতে আমাদের কিছু উপকারও হবে আবার ক্ষতিও হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই বৃষ্টি বরেন্দ্র অঞ্চলের নেমে যাওয়া পানির লেয়ার কিছুটা হলেও পূরণ করবে। আবার মাঠের অনেক জমির ধান নষ্ট হয়ে যাবে।’
এই তো কয়েক মাস আগে অনাবৃষ্টির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক জমিতে বৃষ্টি নির্ভর আমন ধান রোপণ করা সম্ভব হয়নি। আবার যখন ধানগুলো শীষ বের হওয়ার আগ মূহুর্তে এসেছে তখন এমন অতিবৃষ্টি জলবায়ু পরির্বতনের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কারণ জলবায়ু পরির্বতনের ফলে শুধু যে অনাবৃষ্টি হবে এমন নয়। আজকের মতো অতিবৃষ্টির শিকার হয়েও অনেক ক্ষতি হবে।