বৃষ্টি হলেও ক্ষতি আবার না হলেও আমাদের ক্ষতি
রাজশাহী থেকে উত্তম কুমার ও অমৃত সরকার
বরেন্দ্র অঞ্চলে ভৌগলিক কারণেই এই এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কম। এই এলাকা সব সময় থাকে শুকনো। সেচনির্ভর ফসল ও বৃষ্টির উপর নির্ভর করে আমন চাষের পরিকল্পনা করতে হয় কৃষকদের। বিগত সময়ে আমনের সময় বৃষ্টি হতো সময়মতো। আস্তে আস্তে জলবায়ুগত কারণে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরো কমেছে। আবার যেটুকু বৃষ্টি হচ্ছে তাও অনিয়মিত। বিগত ৮-১০ বছরে বৃষ্টি ব্যাপকভাবে অনিয়মিত বলে উল্লেখ করছেন এই অঞ্চলের কৃষকরা। বাংলা বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি হওয়ার কথা। আবার সে সময়ই কৃষকরা আমনের চারা রোপণের চিন্তা করে জমি প্রস্তুত করেন। কিন্তু বিগত কয়েকবছরে এসময় বৃষ্টি না হয়ে প্রকৃতি পুড়ছে প্রচন্ড তাপদাহে।
চলতি বছরে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইর ইউনিয়ন ও মন্ডুমালা এলাকার অনেক জমিতে আমন ধান রোপণ সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ কৃষক একাধিকবার সেচ নিয়ে কোন রকম ধান রোপণ করতে পেরেছিলেন। এ বিষয়ে মন্ডুমালা এলাকার আইরা গ্রামের কৃষক শ্রী স্বপন কুমার (৪৬) বলছিলেন, ‘আমার নিজস্ব জমি আছে ৫ বিঘা এবং ৩ বিঘা জমি লীজ নিয়ে প্রতিবছর ধান চাষ করি। কিন্তু এবার সেচের অভাবে আমার নিজের সব জমি আবাদ করতে পারিনি। এক বিঘা জমিতে ধান রোপণ করতেই ৩ বার করে সেচ নিতে হয়েছিলো।’ এমন চিত্র এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকেরই। যে জমিগুলো পানির অভাবে ধান রোপণ করা যায়নি সে জমিগুলোর মধ্য উল্লেখযোগ্য জমিতে কৃষকরা মাসকালাই বুনে দিয়েছিলেন বিনা চাষে। যদি অল্প বৃষ্টিও হয় তাহলে কিছু মাসকালাই পাবেন সে আশায়।
এর মধ্যে অল্প বিস্তর বৃষ্টি হয়েছে আমন চাষ করতে না পারা জমিগুলোতে কৃষকরা মাসকালাই কিছু সবজি চাষ করেছেন। গাছগুলো বড়ও হয়েছে। কিন্তু বিগত ৫-৬ অক্টোবর এই অঞ্চলে ৩০ বছরে সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। যার ফলে ডুবে যায় প্রায় সকল জমি। নষ্ট হয় অনেক ধান, সবজি ও মাসকালাইয়ের জমি। উঁচু জমির ধান রক্ষা পেলেও রক্ষা পায়নি মাসকালাই ও ও অনেক সবজির জমি। রাজশাহীর তানোর উপজেলার ইলামদহি গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, অনেক জমির মাসকালাই একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির পানির অভাবে এই গ্রামের মোঃ আক্কাস আলী (৫৫) ২ বিঘা জমিতে মাসকালাই চাষ করেছিলেন। তার সবমাসকালাই জমে থাকা পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আর কিছুদিনের মধ্য মাসকালাই ঘরে উঠত কিন্তু আশ্বিন মাসের এসে এই বৃষ্টি সব শেষ করে দিয়েছে। আশ্বিনে এতো বৃষ্টি কখনও হয় না।’ এই গ্রামের মোঃ মখলেচুর রহমান (৪১) এক বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বেগুন চাষ করেছিলেন। অতিবৃষ্টিতে ২দিন জমে থাকা পানিতে তাঁর ৩৮দিন বয়সী বেগুনের সব গাছ মারা গেছে। তিনি বলেন, “বৃষ্টির অভাবে আমাদের ক্ষতি হয় এবার বেশি বৃষ্টি হয়েও আমাদের ক্ষতি হলো।’
এ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে নারীরা বাড়ির আঙ্গিনায় নিজের পরিবারের জন্য সারাবছরই সবজি চাষ করেন। বিগত ২ দিনের অতি বৃষ্টি তাঁদের সবজির বাগানেও ব্যাপক ক্ষতি করে গিয়েছে। অনেকের মিষ্টি কুমড়া, মরিচ ও সীম গাছের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। হরিদবপুর, বেলপুকুর, গোকুল-মোথুরা, বেলনা, দেবীপুর, যোগিশো, মোহর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বাড়ির আঙ্গিনায় চাষকৃত সীম, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, বেগুন, পেঁপে গাছগুলোতে অতিবৃষ্টির ফলে প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। হরিদেবপুর গ্রামের এমন একটি সবজি বাগানে কাজ করছিলেন মোছাঃ তানজিলা বেগম (৩৮)। তিনি বলেন, “এমন বৃষ্টি অধিকাংশ সবজিই সহ্য করতে পারে না। আমার বাগানের মরচি ও বেগুনের সব গাছ মারা গিয়েছে।’ গোকুল-মোথুরা গ্রামের শ্রমিতি শেফালী রানী (৩৬)বলেন, “আমি বেগুন, মরিচ ও পেঁপের বীজতলা তৈরি করেছিলাম সব নষ্ট হয়ে গেছে। আশ্বিন মাসে এতো পরিমাণ বৃষ্টি হলে অনেক ক্ষতি হয়।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলে তাপদাহ বেড়েছে, কমেছে শীতের দৈর্ঘ্য। সাথে অনিয়মিত হয়েছে বৃষ্টিপাত। এবার সময় মতো বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে অনেক জমি পতিত থাকল। আবার অসময়ে অতিবৃষ্টির কারণে অনেক ফসল নষ্ট হয়ে গেল। কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী না হয়েও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।