দু’কাটি ধানে কৃষকের হাসি
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
কথায় আছে ভাতে মাছে বাঙালি। এক সময় গ্রাম বাংলার কৃষকের ঘরে ছিল হরেক রকম ধানের বাহার। হরেক রকমের ধানের চালের ভাত স্বাদ ও গুণ ছিল ভিন্ন। কৃষকগণ উঁচু, মাঝারি, নিচু জমির ধরন অনুযায়ী ধান চাষ করতেন। সবচেয়ে কম খরচে নিজস্ব বীজ, গোবর ও সার ব্যবহারে ধান চাষ হতো মাঠে মাঠে। কৃষকেরা মনের মতো, স্বাধীনভাবে চাষ করতেন। তবে বর্তমানে কৃষকরা যে ধানে ফলন বেশি হয় শুধুমাত্র সে ধান চাষবাদ করার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এতে করে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে ধানবৈচিত্র্য। অন্যদিকে পরিবেশের কথা চিন্তায় না করে চাষাবাদ করছেন হাইব্রিড জাতের ধান, ব্যবহার করছেন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, যা মাটিসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর পদ্মার নিকটবর্তী নিচু এলাকা হওয়ায়, পদ্মার পানি স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বৃষ্টির পানিতেই হরিরামপুরের মাঠ-ঘাট তলীয়ে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আমন মৌসুমে প্রায় প্রতিবছরই ধান চাষ ব্যাহত হয়। আমন মৌসুমে চাষ করতে না পারায়, জমিগুলোতে প্রচুর পরিমাণে কচুরি, বুবলা ও লতানো ঘাস হয়। যার কারণে পরবর্তীতে চাষাবাদে আগাছা পরিষ্কারের অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। তাই পদ্মা নদীর পানির গতিবিধির ওপর ভিত্তি করেই কৃষকরা আমন মৌসুমে দেরিতে ধান চাষ করার প্রস্তুতি নেন। এই সময়ের মধ্যে বোরো মৌসুমে কর্তনকৃত বোরো ধানের গুচি থেকে কুশি নিয়ে ধানের গাছগুলো বড় হতে থাকে। কৃষকগণ এই ধান গাছগুলো দেখে শুনে রাখেন। কারণ ধানগাছগুলো থেকে কৃষকরা চাষ না করেই ধান সংগ্রহ করতে পারেন। ৮০ দিনের মাথায় কৃষকরা জমি থেকে এ ধান সংগ্রহ করেন। এ ধানকে দু’কাটি ধান বা টুরা বলা হয়। আন্ধারমানিকের কৃষক আব্দুল খালেক (৬৮) জানান, কৃষকরা আমন মৌসুমে বিনা চাষে কম সময়ে ও খুব সহজে পরিমাণে কম হলেও ঘরে ধান তুলতে পারেন।
এই প্রসঙ্গে আন্ধারমানিকের আরেক কৃষক কৃষক সুনীল বিশ্বাস (৫৮) বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ, কৃষি কাজ করে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। এই কৃষিই আমাদের সব। পদ্মা নদী আমাদের চকের কাছে হওয়ায় চাষাবাদে আমাদের চিন্তা আরো বেশি করতে হয়। আমন মৌসুমে ধান চাষ করতে হলে চিন্তা হয় আমাদের ধান তলিয়ে নষ্ট হবে কিনা। এজন্য বর্ষা মৌসুম দেখে, একটু দেরিতে চকে ধান চাষ করার জন্য নামি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেরিতে চকে নামার ফলে বোরো মৌসুমে চাষকৃত ধান ও খড় কেটে নিয়ে গেলে জমির অবশিষ্ট অংশ বা ধানের গুচির গুড়া থেকে পোয়া বা কুশি হয়। কুশি বৃষ্টির পানিতে বড় হয়ে ধান হয়। এই ধানকে আমরা টুরা ধান বলে থাকি। জমি থেকে কেটে টুরা ধান সংগ্রহ করি। চকের ৩০ শতাংশ জমি থেকে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ কেজি টুরা ধান সংগ্রহ করি। এই ধানগুলো চিকন হওয়ায় খেতে ভালো লাগে।’
রেবা সরকার (৪৬) বলেন, ‘বোরো মৌসুমে চকে সুশিল, মকবুল, কাইশ্যাবিন্ন, বিয়ার-২৯, ২৮ ধান চাষ করি, তা থেকেই কুশি হয়ে দু’কাটি ধান হয়। আমন ধান চাষ করতে না পারলেও দু’কাটি ধান পেয়ে আমরা খুশি। কোন খরচ নাই, শুধু জমি থেকে কেটে বাড়িতে নিয়ে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এই ধানে মুড়ি ও ভাত ভালো হয়। ধানের বীজ রাখলে সব ধানে চারা হয়। টুরা ধান জমি থাকায় ঘাসও কম হয়। পরবর্তীতে চাষাবাদে আমাদের সুবিধা হয়।’