জমিতে গিয়ে কৃষকরা দেখলেন ধান গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় এমন এক সময় ছিল যখন কৃষকের সম্পদ ছিল বীজ। নিজের পছন্দ অনুযায়ী কৃষক বীজ সংরক্ষণ, চাষাবাদ ও বিনিময় করতেন। সে সময় একজন কৃষকের সম্পর্ক ছিল একজন কৃষকের সাথে। গাছতলায়, জমির পাশে, বাজারে যেখানেই কৃষকরা একত্রিত হতেন তাঁদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল চাষাবাদ সংক্রান্ত। বুদ্ধি, পরামর্শের বিনিময়ে এগিয়ে চলতো কৃষিকাজ। অর্থাৎ তাঁদের উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু বর্তমানে আধুনিক কৃষির যুগে কৃষি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু কোম্পানি এবং বীজের ডিলারগণ। অধিক উৎপাদনের লোভ দেখিয়ে কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছে উচ্চ ফলনশীল/হাইব্রিড বীজ। এসবের অধিকাংশই অপুষ্ট বা মেয়াদোত্তীর্ন বীজ। এসকল বীজ চাষ করে কৃষকরা হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত।
শুনুই ইউনিয়নের মনসুরপুর গ্রামের প্রায় ১৫জন কৃষক নিজেদের জমিতে উফশী ও হাইব্রিড ধান চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের চাষকৃত জমির পরিমান প্রায় ৩০০ কাঠা। চলতি বোরো মৌসুমে তাঁরা ব্রি-২৯, সিনজেন্টাÑ ৮৯ ও হাইব্রিড হীরা-২ জাতের ধান চাষ করেছেন। স্থানীয় বাজারের একজন ডিলারের কাছ থেকে তাঁরা বীজ কিনেছেন। তারপর জমিতে চাষ করেন। কিন্তু বর্তমানে জমির যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে এতে করে কৃষকগণ একমুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারবেন না। কারণ প্রতিটি ধান গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে ও গাছ বাড়ছেনা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্রি-২৯ জাতের বীজ।
কৃষকগণ পৌষ মাসের ১৫ তারিখ থেকে মাঘ মাসের ২০ তারিখ (৩০ডিসেম্বর- ০৩ফেব্রুয়ারী) পর্যন্ত জমিতে ধান রোপণ করেছেন। এর আগে বীজতলায় চারা গাছ ছিল। কিন্তু বীজতলা, জমিতে রোপণ করা পর্যন্ত গাছের কোনো সমস্যা ছিলনা।
বিগত ১৫দিন আগে হঠাৎ করে কৃষকগণ দেখতে পেয়েছেন যে, ধান গাছ বাড়ছেনা। আগে যতটুকু উঁচু ছিল তাও যেনো আরো নীচু হয়ে যাচ্ছে। ধান গাছ যেন আস্তে আস্তে জমির নীচের দিকে যাচ্ছে। জমিতে গিয়ে কৃষকরা দেখলেন ধান গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে তাঁরা বীজের ডিলারের শরণাপন্ন হলেন। সেই ডিলার জমিতে জিংক পাউডার ছিটানোর পরামর্শ দিলেন। কৃষকরা তাই করলেন। কিন্তু তাতে গোড়া পচা রোগের কোনো কাজ হয়নি, গাছ সবুজ হয়েছে মাত্র।
ক্ষতিগ্রস্ত ধান গাছ নিয়ে কৃষকগণ উপজেলা কৃষি অফিসেও যোগাযোগ করেছেন। তাঁরাও এ বিষয়ে কোনো পরামর্শ দিতে পারলেন না। পচে যাওয়া ধানগাছগুলো এখন গরুতেও খেতে চায়না। কৃষকদের এই অবস্থায় ক্ষতি মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ফসলের আশায় কৃষকরা খরচ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। কেউ নিজের টাকায় অথবা কেউ ধার করে এই মৌসুমে জমি চাষ করেছিলেন। ফসল তুলে ধার শোধ করার কথা ছিল। এখন আর সেই উপায়ও নেই। যে ফসল কৃষকের একমাত্র আয়ের উৎস, সেই ফসল এখন আর কোনো কাজে আসবেনা। মাঠের পর মাঠ সবুজ হয়ে আছে কিন্তু সেখানে সোনালি ফসল দেখা যাবেনা।
ধান উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরাশক্তি। এছাড়া বীজ সংরক্ষণে কৃষকদের অনাগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কারণে রমরমা হচ্ছে ডিলারদের ব্যবসা। কোম্পানির সাথে তৈরি হচ্ছে কৃষকের সম্পর্ক। অধিক লাভের আশায় কিছু কিছু কৃষক নিজেদের চর্চা, ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়ে আধুিনকতার দিকে ছুটে চলছেন। এই পথে তাঁদের ক্ষতি ছাড়া লাভ যে কম হচ্ছে সেটি তাঁরা এখনো উপলব্ধি করতে পারছেন না। যেদিন পারবেন সেদিন নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদন এবং যোগান দিয়ে কৃষকগণ সর্বোচ্চ লাভবান হতে পারবেন।
তথ্যদাতা: মো: রুবেল, মো: লিয়াজ উদ্দিন, মো: বজলুর রহমান, মনসুরপুর, শুনুই, আটপাড়া।