কৃষাণীর চর্চা ও অভিযোজন

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বাংলাদেশের ঐতিহ্যে কৃষি একটি অন্যতম স্থান দখল করে আছে। একজন কৃষকের ধ্যান, জ্ঞান সবকিছু কৃষিকে ঘিরেই। ধারাবাহিকভাবে ফসল উৎপাদন, কোন মাটিতে কোন বীজ রোপণ, কখন পরিচর্যা করতে হবে, এইসব কর্মপরিকল্পনা তাঁদের নৈমিত্তিক কাজেরই অংশ। একজন কৃষাণী প্রাণান্ত পরিশ্রম করে তাঁর পরিবারের সকল কাজ করেন। নিজের পরিবারের মানুষদের পুষ্টি নিশ্চিত করা, পরিবারে বাড়তি কিছু আয়ের ব্যবস্থা করা সর্বোপরি নিজেকে আয়বর্ধনমূলক কাজের সাথে যুক্ত করার জন্যই তাঁদের সকল প্রচেষ্টা।


বানিয়াজান ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামের ফাতেমা আক্তার একজন কৃষাণী। স্বামীর ঘরে আসার পর থেকেই সংসারের কাজে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। সারাদিন নানান ধরণের কাজ করার পরও তাঁর হাতে অফুরন্ত সময় থাকে। এই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য তিনি বাড়ির আঙিনায় শুরু করেন কৃষিকাজ। প্রায় পনেরো বছর যাবৎ তিনি সব্জির চাষাবাদ করছেন।
তাঁর বাড়ির লাগোয়া ১৫ শতাংশ জায়গা আছে। সেখানেই শুরু করেন সব্জি চাষ। প্রথম অবস্থায় তিনি একজন প্রতিবেশি কৃষাণীর কাছ থেকে কিছু বীজ সংগ্রহ করেছিলেন। এরপর নিজের বাবার বাড়ি, আত্মীয় বাড়ি গেলে সেখান থেকেও বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। সেই বীজ অনেক যতœ করে রোপণ করতেন। এভাবেই তিনি শুরু করেন নতুন পথচলা।


প্রথম অবস্থায় কয়েক ধরণের সব্জি ছিল তাঁর বাড়িতে। কিন্তু আস্তে আস্তে জাত সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ফাতেমা আক্তারের সব্জির জমিতে ২১ ধরণের সব্জি আছে। সমস্ত বীজ তিনি নিজে সংরক্ষণ করেন।
এবছর গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ায় প্রচ- রৌদ্রতাপ দেখা দিয়েছে সর্বত্র। বৃষ্টি নেই, খরা। মাটি শুকিয়ে ঝরঝরে। এত রোদের তাপ যে, মাটি থেকেও গরম তাপ বের হয়। এই তাপপ্রবাহের কারণে কৃষকদের সব ধরণের ফসল বিশেষ করে সব্জি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। মাটিতে রস না থাকায় সব্জির গাছ শুকিয়ে গেছে, পাতা পুড়ে গেছে। সব্জির ফলন হয়নি। কিন্তু এই দুর্যোগকালীন সময়েও ফাতেমা আক্তারের সব্জির জমিতে তাপদাহের কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ তিনি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেছেন। তাও আবার তাঁর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়।


সাধারণত সব্জি গাছের গোঁড়ায় বা জমিতে পুকুর বা অন্যান্য উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে সেচ দিতে অনেক সময় প্রয়োজন এবং কষ্টসাধ্য। কিন্তু ফাতেমা আক্তার একটি বিকল্প পথ অবলম্বন করে সেচের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি তাঁর সব্জির জমির একপাশে একটি বড় করে গর্ত করেছেন। এই গর্ত করায় তাঁর দুই দিক দিয়ে সুবিধা হয়েছে। একদিকে গর্তের মাটি দিয়ে জমিটুকু উঁচু করেছেন অন্যদিকে গর্তটি পানি দিয়ে ভরাট করেছেন। সেই গর্ত থেকে প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করে জমিতে সেচ দিতে পারছেন।


প্রথম অবস্থায় অবশ্য পুকুর থেকে, মর্টারের সাহায্যে পানি দিয়ে গর্তটি ভরাট করেছিলেন। এরপর বৃষ্টির পানি দিয়ে গর্ত ভরেছেন। এখন এই গর্তের ভেতর সারাবছর পানি থাকে। তাই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় তাঁর সব্জির কোনো ক্ষতি হয়নি। গ্রামের অন্যেরা যখন সব্জি সংগ্রহ করতে পারছেনা বা বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে সেখানে ফাতেমা আক্তারের সব্জির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এবং বাজারে বিক্রি করেও বাড়তি উপার্জন করতে পারছেন।
রোদে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় তাঁর ফসল অনেক পুষ্ট হয়েছে, কোনো রোগবালাইও হয়নি। প্রতিবেশিরা বাজারে না গিয়ে তাঁর কাছ থেকে সব্জি কিনে নেন। এছাড়া বাজারে নিলেও তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। ভালো দাম দিয়েও বিক্রি করতে পারছেন। ফাতেমা আক্তার তাঁর মেয়েকে নিয়ে সব্জির জমির পরিচর্যা, সংগ্রহ এগুলো করেন। আর তাঁর স্বামী বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন।


তাপদাহের কারণে সমস্ত গ্রাম/এলাকায় যেখানে কৃষকগণ চাষাবাদ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেখানে ফাতেমা আক্তার নিজের বুদ্ধির সাহায্যে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে পেরেছেন। প্রতিবেশি দুইজন কৃষাণীকে তিনি পরামর্শও দিয়েছেন, তাঁর মতো করে সেচের ব্যবস্থা করতে। কৃষাণীদের ভিন্ন ভিন্ন চর্চা ও অভিযোজনের ফলেই টিকে আছে আমাদের কৃষি, ঐতিহ্য।

happy wheels 2

Comments