পরিবেশ সুরক্ষায় একটি সফল সামাজিক বনায়নের গল্প

শ্যামনগর,সাতক্ষীরা থেকে ফজলুল হক

আমরা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ, আমাদের প্রতিনিয়ত নানান ধরণের দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। আগের তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন বেড়েই চলেছে, বছরে প্রায় ৩/৪ বার দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়, কখনো ঘূর্ণিঝড়, কখনো জলোচ্ছ্বাস, কখনো বন্যা, কখনো খরা, কখনো নদী ভাঙন ইত্যাদি। উপরোক্ত দুর্যোগগুলো বেশি বেশি উপকূলীয় অঞ্চলে হওয়ার পিছনে জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী বলে বিবেচিত হয়েছে, সে কারণে  বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন,  প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে বৃক্ষরোপণই ছিলো প্রথম এবং প্রধান শর্ত। সেই লক্ষ্য নিয়ে বনায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করি।

সালটা ছিলো ২০২১ আমি তখন বারসিকে যুব সংগঠক হিসাবে কাজ করি, আমার মূলত প্রধান কাজ ছিলো এলাকার যুব সমাজকে একত্রিত করে স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব সৃষ্টি করা, সংগঠন তৈরী করা এবং সেই সংগঠনের মাধ্যমে এলাকার সামাজিক কাজ করা। বারসিক যুবদের সমাজিক কাজগুলোকে গুরুত্বসহকারে দেখতো এবং প্রায় সকল সামাজিক কাজে সহযোগিতা করতো। সেই কাজের ধারাবাহিকতায় শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের আবাদ চণ্ডিপুর চুনা ও বনবিবিতলার মধ্যে দিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার পিচের রাস্তা ছিলো, পিচের রাস্তার দুপাশ দিয়ে কিছু কিছু জায়গা ছিলো জনবসতি আর বেশির ভাগ জায়গা ছিলো ফাঁকা, একটি গাছও ছিলো না। ২নং ওয়ার্ডটাও ছিলো আমার নিজ এলাকার মধ্যে, আমি আবার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলাম, সে জন্য বনায়নটি করার জন্য নিজের আগ্রহ ছিলো বেশ এবং পরবর্তীতে  নিজে নির্বাচন থেকে সরে  গিয়েছিলাম।

অনেক দিন ধরে চিন্তা করি রাস্তাটি দু’পাশ দিয়ে গাছ লাগাবো। এলাকার অনেক যুবদের সাথেও আলোচনা করি,তারাও বনায়নের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে। স্থানীয় যুবদের মতামতে আরো আগ্রহ বাড়লে  প্রথমে বারসিকের অফিসে বিস্তারিত জানাই এবং সামাজিক বনবিভাগকে জানাই। তার কারণ আগের অনেক সামাজিক বনায়নের বারসিক ও সামাজিক বনবিভাগ মিলে অনেক বনায়ন গড়ে তুলেছিলো। সেই জানা, বুঝার জায়গা থেকে বিশেষ করে বারসিকের বাবলু জোয়ারদার ও সামাজিক বনবিভাগের পিরামিন ইসহাক এক সাথে বসে আলোচনা করে রাস্তা দেখতে যাই। আলোচনায় আমি বলেছিলাম প্রথমে এক কিঃমিঃ দিলেই হবে। তারপর রাস্তা দেখলো,  সামাজিক বনবিভাগের পিরামিন ইসহাক উদ্ধর্তণ কতৃপক্ষকে ছবিও পাঠালন, আলোচনাও করলন সামাজিক বনবিভাগের সাতক্ষীরা অফিসে, তার পর রাজী হয়ে গেলো বনায়নের জন্য, আর বললো, বনায়ন যদি করতে হয়, তাহলে সাড়ে তিন কিঃমিটার করতে হবে, অর্থাৎ বনায়নটি হবে চুনার জগদীশের বাড়ী থেকে বনবিবিতলার সোনাতনের দোকান পযর্ন্ত। আমি রাজী হয়ে গেলাম। তার পর বনায়ন করার জন্য এলাকার যুব সমাজ,গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং প্রবীণ মানুষসহ সকলে মিলে কয়েকবার আলোচনায় বসলাম, আলোচনায় বসার পরে সকলে আগ্রহ প্রকাশ করলো বনায়ন করতে। 

পরবর্তীতে ৫ জুন ২০২১ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বারসিকের সহযোগিতায় বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে সামাজিক বনায়নের শুভ উদ্বোধন হলো। উদ্বোধন হওয়ার পরে স্থানীয় এলাকার যুব সমাজের ৪১ জনকে নিয়ে আবাদ চণ্ডিপুর বনায়ন সুরক্ষা নামে একটি কমিটি হলো। পর্যায়ক্রমে গাছ লাগানো শুরু করা হলো। বনায়নটিতে বাবলা, খৈই, অর্জুন মেহগনী কদবেল, আকাশ মনি, রেইন্ট্রি, শিশু, নিম, খয়ের, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা,  ইপিল, ঝাউ, কদম, বকাইন, পরশপেপুল। বনায়নটি গ্রামে হওয়ার ছাগলের উপদ্রব বেশি ছিলো এবং কিছু মানুষ গাছ লাগাতে দেবে না বলে অনেক গাছ নষ্টও করে দিয়েছিলো,পরবর্তীতে এলাকার যুব সমাজকে নিয়ে বনায়ন ও গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে একাধিকবার আলোচনা ও মাইকিং করে সচেতন করেছিলাম। পরবর্তীতে আর কোন সমস্যা হয়নি। বনায়নটি অনেক বেশি দৈর্ঘ্য হওয়ায় সামাজিক বনবিভাগ থেকে এবং বারসিক থেকে একজন করে মোট দুই জন পাহারাদার ছিলো, একই সাথে বারসিক বনায়নটি সুরক্ষার জন্য উপকরণ দিয়ে সহযোগিতাও করে যাচ্ছে। বনায়নটিতে এলাকার স্থানীয় ৪১ জন সদস্য বিশিষ্ট সামাজিক বনায়ন সুরক্ষা নামে একটি কমিটি করা হয়েছিল। তার মধ্যে কিছু যুবক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো বিশেষ করে তাপস সরকার, বিবেকানন্দ,সুমনসরদার, ফয়সাল আহমেদ, কালাম, সুদর্শন। বনায়নটিতে প্রথম বছরে প্রায় পাঁচ হাজার গাছ রোপণ করা হয়েছিলো। নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বনায়নটি আজ দৃশ্যামান হয়েছে, ধুধু মরুভূমির মত ফাকা রাস্তাটির আজ সবুজের সমরোহ। প্রতিদিন বিকালের রাস্তাটিতে দেখা মিলে লোকজন ভিড়। বনায়নটি আরো দৃশ্যমান করার জন্য  দ্বিতীয় বছরেও আরো সামাজিক বনবিভাগের সহযোগিতায় দুই হাজার গাছ রোপণ করা হবে। 

আমি বারসিকে কর্মরত থাকাকালীন বনায়নটির উদ্যোগ নিয়েছিলাম এবং বারসিক বনায়নটি শুরু থেকেই দৃশ্যমান বনায়নে পরিণত হওয়ার জন্য নানানভাবে আজও সহযোগিতা করে যাচ্ছি, সেজন্য আজ এই সফল বনায়নের কৃতিত্ব বারসিকের। বারসিক দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ সুরক্ষা,জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে। আসুন আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে পৃথিবীটাকে সুরক্ষা করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে কমাতে বৃক্ষ রোপণ করি।

happy wheels 2

Comments