পূরণ হয়েছে প্রত্যাশা
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। নিচু এলাকা ও বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর বন্যা, নদী ভাঙনে জনগণের জান মালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। হরিরামপুরের চর এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হওয়ার কারণ হিসাবে এলাকার জনগণ মনে করেন প্রায় ৩০ বছর আগে পদ্মার চর জাগে এবং মানুষের বসতি গড়ে উঠে। এই মনুষ্য বসতি শুধু অল্প কিছু প্রজাতির গাছপালা রোপণ করে। এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে স্বল্প পরিসরে কিছু ফলের ও কাঠের গাছ দেখা যায়। হরিরামপুরের মূলভুমি এলাকায়ও একই প্রজাতির ফল ও কাঠ গাছ চোখে পড়ে। কিন্তু এই এলাকায় খুব কমই দেখা যায় তাল, খেঁজুর ও বট-পাকুড় গাছ। হরিরামপুর পদ্মা তীরবর্তী হওয়ায় নদী ভাঙন এবং বন্যায় রাস্তা-ঘাট ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য স্থানীয় যুবকদের সহযোগিতায় তাল ও খেজুর বীজ বপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
আন্ধারমানিক স্বেচ্ছাসেবক টিম, লেছড়াগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক টিম, কৌড়ি স্বেচ্ছাসেবক টিমের উদ্যোগে ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময় তাল ও খেঁজুর বীজ বপন কার্যক্রম শুরু হয়। যুবকদের উদ্যোগকে আরো শক্তিশালি করার জন্য সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম চলতে থাকে। তাল ও খেঁজুর বীজ বপনে কৃষক-কৃষাণি ও গাছি সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধকরণে স্কুল, কলেজ ও গ্রাম পর্যায়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তাল ও খেঁজুর বীজ বপন করেন। গ্রাম পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য নিয়ে জানা যায় প্রায় ৮০০ তাল ও খেঁজুর বীজ বপন করেন রাস্তার পাশে, জমিতে ও নিজ বাড়িতে। চালা বাজারের রাস্তায় তাল খেঁজুর বীজ বপনের সময় স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্য সোলাইমান হোসেন আন্ধারমানিক বলেন, “শুনেছি তাল গাছে ফল ধরতে অনেক সময় লাগে। তাল গাছে ঠাডা বা বিদ্যুৎ পড়ে। এজন্য মানুষ তাল ও খেঁজুর গাছ কম লাগাতো।” কৌড়ি স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্য পলাশ মিয়া বলেন, “তাল গাছে ঠাডা বা বিদ্যুৎ পড়ে বলেই মানুষসহ অন্যান্য প্রাণির উপর পড়ে না, ফলে জান-মালের ক্ষতি কম হয়।” স্বেচ্ছাসেবক টিম, স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্যোগে তাল ও খেজুর বীজ সংগ্রহ করেন। তাল ও খেজুর বীজ বপনে স্বেচ্ছাসেবকদের পাশে থেকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা এবং উদ্বুদ্ধ করেছেন মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক প্রশাসক মো. নাজমুস সাদত সেলিম, হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবিনা ফেরদৌসি ও কাজী আরেফিন রেজওয়ান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবুল বাশার সবুজ, উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ জহিরুল হক এবং কৌড়ি কলেজের অধ্যক্ষ বিজয় কুমার রায়।
লোকসংগীত আর হাজারী গুড়কে মানিকগঞ্জ জেলার ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। এমনকি মানিকগঞ্জের লোগোতেও একই বিষয়টিতে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে- “লোক সংগীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর”। ব্র্যাডিং আইটেম হিসাবে হাজারী গুড়ের ব্যাপক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে ১৮ জুলাই ২০১৭ ইং তারিখ হরিরামপুর উপজেলার দিয়াবাড়ি থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে খেঁজুর বীজ বপন করা হয় ন। জেলা প্রশাসক মোঃ.নাজমুস সাদত সেলিম আনুষ্ঠানিকভাবে এই রোপণ কর্মসূচী উদ্বোধন করেন। হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবিনা ফেরদৌসি হরিরামপুর উপজেলার চালা ইউনিয়নের চালা বাজার হইতে কামারগোনা আজিজুল হক তারা মোল্লার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় শিক্ষার্থী ও তরুণদের উদ্যোগে তালের বীজ বপন কার্যক্রম উদ্ভোধন করেন ও পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণে উৎসাহী করেন। ফলে কৃষকগণও তালের বীজ রাস্তায় লাাগানোর পাশাপাশি নিজ জমিতে, বাড়ির পাশে, রাস্তার পাশে রোপনে উদ্যোগী হয়।
২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত হরিরামপুর উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক টিমের সমন্বয়ে চালা বাজার থেকে কামারগোনা, দড়িকান্দি পাকা রাস্তা হতে দড়িকান্দি মাদ্রসা, কৌড়ি থেকে সাপাইর, লাউতা থেকে হেলাচিয়া, দিয়া বাড়ি থেকে দুর্গাপুর, আন্ধারমানিক নৌকা ঘাট থেকে দাসকান্দি বেরিবাঁধ, হরিনা ঘাট থেকে পাটগ্রাম বাজার, হরিনা তিন রাস্তার মোড় থেকে মান্নার মিয়ার বাড়ি, নটাখোলা হাই স্কুল থেকে বালিয়া চক পর্যন্ত মোট ১৫ কিলোমিটার রাস্তায় তাল ও খেঁজুর বীজ বপন করা হয়। উক্ত রাস্তার পাশে তাল ও খেঁজুর বীজ বপনে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্যদের সাথে হাতে হাত মেলায় শিক্ষার্থী, কৃষক-কৃষাণি এবং স্থানীয় প্রশাসন।
স্বেচ্ছাসেবক টিমের উদ্যোগে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে যে সকল রাস্তায় তাল ও খেঁজুর বীজ বপন করা হয় সেই সমস্ত তাল ও খেঁজুরের চারা ২ ফিট বড় হয়েছে। এলাকার জনগণই সমন্বয় করে তাল ও খেঁজুর চারাগুলো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। তাল ও খেঁজুর বীজ বপনে যেসকল লোকজন অংশগ্রহণ করেন তারাই পরিচর্যা করছেন। পাটগ্রামচরে কৃষক সিদ্দিক মোল্লা (৫৫) বলেন, “চর এলাকায় তাল ও খেজুর গাছ নেই। রাস্তার পাশে তাল ও খেজুর বীজ উৎসাহ নিয়ে বপন করা হয়েছে। এখন রাস্তার পাশে তাকালেই দেখা যায় তাল ও খেজুর গাছ বড় হয়ে উঠছে। আমাদের কাছে দেখতে ভালো লাগে।” বাহিরচরের কৃষক শহিদ বিশ্বাস (৪৫) বলেন, “তাল ও খেজুর গাছ কমে গেছে, কারণ আমরা এখন লাগাই না। বারসিক ও স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্যোগে রাস্তার পাশে তাল খেঁজুর বপন পরিবেশবান্ধব কাজ। এক সময় রাস্তার পাশে খুব সুন্দর দেখা যাবে।” তিনি আরো বলেন, “আমরা আমাদের এলাকা থেকে তাল এবং খেঁজুর রস ও গুড় তৈরি করে খেতে পারব। পাখিরা বাস করবে, কৃষকের ফসল রক্ষা হবে, আমরা সবাই মিলে সবুজ পৃথিবীতে ভালো থাকব।”